অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সারাহ ইসলামের দান করা কর্নিয়ায় চোখের আলো ফিরে পেলেন অন্ধত্বের কাছাকাছি থাকা দুই নর-নারী। চোখের আলো ফিরে পেয়ে তাঁরা বিস্ময়ে অভিভূত। এটা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। চক্ষুদাতা সারাহ এবং তাঁর পরিবারের প্রতি তাঁরা হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।
কর্নিয়া দুটি বসানো হয়েছে শিক্ষিকা ফেরদৌস আখতার (৫৬) ও মোহাম্মদ সুজনের (২৩) চোখে। ফেরদৌসের অস্ত্রোপচার হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এবং সুজনের সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর দু’জনই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের স্বজন ও চিকিৎসকরা।
এর আগে বুধবার সারাহর মৃত্যুর পরপরই তাঁর দুই কিডনি শামীমা আহমেদ ও হাসিনা আক্তারের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা পাবনার ঈশ্বরদীর স্কুলশিক্ষিকা ফেরদৌস আখতারের চিকিৎসা চলছে বিএসএমএমইউতে। শুক্রবার বিকেলে তিনি জানান, ২০১৬ সালে এক অজানা ভাইরাসে তাঁর ডান চোখে সমস্যা দেখা দেয়। কিছুই দেখতে পেতেন না। স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিকে চোখ দেখালেও সমাধান মেলেনি। পরে বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শীষ রহমানের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। সাত বছর আগে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন এ চিকিৎসক। তবে কর্নিয়া সংকটে এটি এতদিন করা সম্ভব হয়নি। কর্নিয়া জোগাড় করতে আগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দিয়ে রেখেছিলেন এ শিক্ষিকা।
সারাহর কর্নিয়া দানের সম্মতি পেয়েই চিকিৎসক শীষ রহমান ফেরদৌসকে ফোন করে ঢাকায় আসতে বলেন। বুধবার রাতেই তাঁর কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। শুক্রবার সকালে তাঁর চোখের সাদা ব্যান্ডেজ খুলে দেন চিকিৎসক। ডান চোখে এখন স্বাভাবিকভাবে দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
ফেরদৌস আখতার বলেন, এ এক অন্যরকম অনুভূতি। চোখে সমস্যার কারণে স্কুলের চাকরি ছাড়তে হয়েছে। সেই চোখে এখন সব দেখতে পাচ্ছি। এটা সম্ভব হয়েছে সারাহ ইসলামের সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে। চোখ খুলেই সারাহ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাঁর মাকে সান্ত্বনা দিয়েছি। সারাহ যেন জান্নাতবাসী হন, সেই দোয়া করেছি। কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ফেরদৌস।
সারাহর অন্য একটি চোখের গ্রহীতা সুজনের বাঁ চোখ অন্ধ ছিল। তিনি নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। গত তিন বছর ডোনার সংকটে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করতে পারেননি। সারাহ তাঁরও দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন।
চোখে আলো ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত সুজন স্বজনদের বলেছেন, ‘আমার চোখ ভালো হয়ে গেছে। আমি সব দেখতে পাচ্ছি। তবে সম্পূর্ণ পরিস্কার নয়।’ চিকিৎসক বলছেন, ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হবে। সুজন আরও বলেছেন, সারাহ শুধু আমার চোখের আলো ফেরাতেই বড় ভূমিকা পালন করেননি, মরণোত্তর চক্ষুদানে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর এ দান মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। সারাহর প্রতি ভালোবাসা।
সুজনের চোখের অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাশ। তিনি বলেন, সুজন এখন সুস্থ আছেন। বাঁ চোখে ভালো দেখতে পারছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে শনিবার সকালে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর ৬ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর চোখে আলো ফেরে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শীষ রহমান জানান, এ দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে কর্নিয়াজনিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ মানুষের দুই চোখই অন্ধ এবং প্রায় ৪ লাখ মানুষের এক চোখ অন্ধ। এর বিপরীতে দেশে প্রতিবছর কর্নিয়া সংগ্রহ হয় মাত্র ১ হাজার। এরও বেশিরভাগই আসছে বিদেশ থেকে। বিদ্যমান আইনের মৃত মানুষের কর্নিয়া সংগ্রহ বাধা না থাকলেও নানা কারণে এটি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
এদিকে সারাহর কিডনি গ্রহণকারী মিরপুরের শামীমা আহমেদের স্বামী মনি মিয়া বলেন, তাঁর স্ত্রী ভালো আছেন। পাঁচ বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। টানা চার বছর তাঁর স্ত্রীর ডায়ালাইসিস করতে হয়েছে। এতে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বুধবার রাতে অস্ত্রোপচারের পর এখনও বিএসএমএমইউর আইসিইউতে রয়েছেন তিনি। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। প্রস্রাবও হচ্ছে। মনি মিয়া বলেন, স্ত্রীর জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কিডনিদাতার পরিবারের খোঁজ নিয়েছে। সে সবার সঙ্গে কথাও বলেছে। খাবারও খাচ্ছে।
সারাহ ইসলামের অন্য কিডনিটি প্রতিস্থাপন করা হয় রাজধানীর মিরপুরের বেসরকারি কিডনি ফাউন্ডেশনে হাসিনা আক্তারের শরীরে। হাসপাতালের প্রধান ও দেশের বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, কিডনি গ্রহীতা ভালো আছেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। তাঁদের একটি অংশের বেঁচে থাকতে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। ডায়ালাইসিস অনেক কষ্ট এবং এর খরচও অনেক। দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডায়ালাইসিস কেন্দ্রও নেই। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকার অন্য বিকল্পটি হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। মানুষের কিডনি দুটি। একটি কিডনি অন্যকে দেওয়া যেতে পারে। একটি কিডনি নিয়ে মানুষ পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারেন। তবে প্রতিস্থাপনে ডোনার পাওয়া কঠিন।
গত বুধবার দেশে প্রথম মৃত ঘোষিত কোনো ব্যক্তির (সারাহ ইসলাম) কিডনি অন্য কোনো রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটা দেশের চিকিৎসাসেবায় মাইলফলক। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বিএসএমএমইউর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২০ বছরের সারাহ। তিনি তাঁর অঙ্গদান করে যান।
তবিবুর রহমান