বাণিজ্য সুবিধা কূটনীতি আর লবিস্টই ভরসা

0
179
সরকারের নানামুখী কৌশল

বাংলাদেশ ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের একের পর এক নেতিবাচক চিঠিকে চাপ হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার। প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিলেও নেতিবাচক প্রচারণা ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে ঢাকা। সেই সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি লবিস্ট নিয়োগ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আওয়ামী লীগ। ঢাকার তরফ থেকে নেতিবাচক প্রচারণার ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইস্যুতে সরব যুক্তরাষ্ট্রের ১২ কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কয়েকজন সংসদ সদস্য। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১২ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা দপ্তরের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেলকে চিঠি দিয়েছেন সংস্থাটির ছয় সংসদ সদস্য। একই বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেনকে ৮ জুন চিঠি লেখেন ছয় কংগ্রেসম্যান। এ ছাড়া গত ২৫ মে আরও ছয় কংগ্রেসম্যান এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে এমন চিঠি দিয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে এ দেশের সংবিধান, আইন ও প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন কংগ্রেস বা অন্য মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে বলার কে? তারা নিজেদের এত বড়ই বা মনে করে কেন? তিনি বলেন, এদের এসব চিঠি বা বিবৃতি আমাদের কাছে বিবেচ্য কোনো বিষয় নয়। তারপরও দলীয়ভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে, যাতে এ নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়।

বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলতে দেশের বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে পশ্চিমা বিশ্বে লবিস্টে অর্থ খরচ করা হচ্ছে বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, লবিস্ট তার কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান বা ইইউর সংসদ সদস্যদের চিঠি জোগাড় করে দিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেবে, সেটিই বড় বিষয়। ইইউর সংসদ সদস্য ও ইপিপি সদস্য স্টেফানেক ইভান এর আগে ২০২২ সালে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইইউতে চিঠি দিয়েছিলেন। তবে সেই চিঠির উত্তরে জোসেপ বরেলের কাছ থেকে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশংসাসূচক উত্তরই পেয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশ ইস্যুতে আরও বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়াতে ভূমিকা রাখছে বিরোধী পক্ষগুলো। চিঠিগুলোতে যা দাবি করা হয়, তা আমলে না নেওয়ার অন্যতম কারণ– বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল নেই। ফলে এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা ঠেকাতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার ও লবিস্টকেই কৌশল হিসেবে দেখেছে।

মার্কিন আইন দপ্তরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বাংলাদেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে নেলসন মুলিনস রিলে অ্যান্ড স্কারবোরো এলএলপিকে গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও নিয়োগ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিতে সই করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশকে সেবা দেবে নেলসন মুলিনস। এ জন্য মাসে অন্তত ২০ হাজার ডলার খরচ করতে হচ্ছে সরকারের।

নেলসন মুলিনস ছাড়াও নুরনবার্গার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন, পোটোম্যাক স্কয়ার গ্রুপ, মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস এবং বিজিআর পাবলিক রিলেশন বাংলাদেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ও পিআরের কাজগুলো করছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশকে বাংলাদেশের হয়ে নিয়োগ দিয়েছে নেলসন মুলিনস।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হয়ে লবিস্ট বা পিআর নিয়োগের বিষয়টি  নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, পিআর করার উদ্দেশ্যে এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে আইস মিলার এলএলপি নামে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৬ মাস বা তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালে। প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগকর্তা হলেন সরকারদলীয় ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। চুক্তি অনুযায়ী বছরে ১ লাখ ৬২ হাজার ডলার পরিশোধ করা হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা চুক্তি অনুযায়ী সে বছরের ১ মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠানটি সেবা দেওয়া শুরু করেছে। আইস মিলার বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বাড়াতে তাহজীব আলম সিদ্দিকী কৌশল তৈরি করে দেবে। বিশেষ করে মানবাধিকার ও জঙ্গিবাদ দমন নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকসহ বাইডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে।
এ বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কোনোভাবেই পশ্চিমা দেশগুলোকে চটাতে চাইছে না সরকার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। ফলে গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে চীন বক্তব্য দিলেও গতকাল বৃহস্পতিবার সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকারের প্রতি সব দেশের সম্মান জানাতে আহ্বান জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ইইউর থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলানোকে অগ্রাধিকার হিসেবে নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে না থাকলেও যাতে বিপক্ষে না যায়, সে জন্য দেশটির উদ্বেগের জায়গাগুলো আমলে নিয়ে তা নিরসনে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
র‍্যাব ও শ্রম বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম আগের তুলনায় প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হয়েছে। কোনো ক্রসফায়ার বা মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত কিছু হলে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বেচ্ছায় সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল। সেই উদ্বেগও দূর করার বিষয়ে কাজ চলছে। সংসদের এই অধিবেশনে শ্রম আইনের সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। জুলাইয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা অনেক বিষয়েই নেওয়া পদক্ষেপ আরও দৃশ্যমান করবে সরকার।

সূত্র জানায়, শ্রম আইন সংশোধন হলেই আগামী ১১ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া এবং এর পরপরই আরও একজন অর্থনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে। জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, যেটাতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আর আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করবেন। এ দুটি বৈঠকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।

বাংলাদেশ ইস্যুতে চীন-রাশিয়ার হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাওয়ার কারণ নিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, চীন একসময় বিএনপির ভালো বন্ধু ছিল। তবে গত ১৪ বছরে চীন তার অবস্থান পাল্টেছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের যে পর্যায়ে এনগেজমেন্ট হয়েছে, কোনো কারণে যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আবার না আসে, তাহলে কৌশলগত ও ব্যবসায়িক দিক থেকে তারা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই মনে করছে। ফলে নিজ স্বার্থেই চীন বর্তমান সরকারের পক্ষ নিচ্ছে। আর রাশিয়া বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতি নিয়ে রয়েছে। যে কোনো স্থানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। সেই নীতি থেকেই রাশিয়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য পশ্চিমা দেশগুলো নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় ক্ষমতাসীন সরকার। এ ক্ষেত্রে ব্যবসা ও কূটনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন– সম্প্রতি যুক্তরাজ্যকে এয়ারবাসের একটি বড় ব্যবসা দিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটি থেকে নৌবাহিনীর জন্য জাহাজও কেনার কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অন্যতম বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সিমেন্সকে গত ১৪ বছরে বড় অঙ্কের ব্যবসা দিয়ে জার্মানিকে কাছে টেনেছে। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে কৌশলগত পর্যায়ে সম্পর্ক নিয়ে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে।

ফ্রান্সের সঙ্গেও সম্পর্ক বেশ এগিয়েছে ঢাকার। দেশটি বাংলাদেশের পঞ্চম বাণিজ্যিক অংশীদার। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে স্যাটেলাইট কিনেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়ানোর বিষয়ে কাজ চলছে। পাশাপাশি ইউরোপের দেশ ইতালির সঙ্গেও বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে সরকার। এভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিজ পক্ষে রাখতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা।

এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ২৮ দেশ নিয়ে ইইউ। ফলে তাদের সংসদে কিছু করতে গেলে ভোটাভুটির বিষয় থাকে। ইইউতে বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি। আর এ তিনটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের বেশ ভালো। এতে করে ইইউ থেকে নেতিবাচক কিছু ঘটবে– এমনটা মনে করে না ঢাকা। আর বাংলাদেশ ইস্যুতে এসব পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকেই হাত করা এখন পর্যন্ত মূল চ্যালেঞ্জ।

আসছে জাতীয় নির্বাচনে জাতিসংঘ থেকে কোনো রকম চাপ প্রত্যাশা করছে না বাংলাদেশ। তবে সতর্ক রয়েছে। কারণ জাতিসংঘের কর্মপরিধি অনুযায়ী, কোনো সরকার যদি নির্বাচনের বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে আমন্ত্রণ জানায়, তাহলে সেখানে ভূমিকা রাখে তারা। এ ছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) থেকে যখন কোনো রেজ্যুলেশন পাস হয়, তখন সংশ্লিষ্ট দেশে হস্তক্ষেপ করা হয়।

সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের সহযোগিতা চায়নি। আর বাংলাদেশে এমন কোনো যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়নি যে ইউএনএসসিতে কোনো রেজ্যুলেশন উঠবে।

তাসনিম মহসিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.