বাইডেন–ফ্লেশন, পুতিন–ফ্লেশন নাকি বাংলা–ফ্লেশন

0
147
গভর্নর হওয়ার পরে প্রথম মুদ্রানীতি

অনেকটা সেই টাক মাথায় চুল গজানোর বিজ্ঞাপনের মতো—চিকিৎসার আগে ও পরে। এবারের মুদ্রানীতিকেও এভাবে বিশ্লেষণ করা যায়—আইএমএফ আসার আগে ও পরে। এ জন্য অবশ্য বেশি দূরে যেতে হবে না। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হওয়ার পরে প্রথম মুদ্রানীতি দিয়েছিলেন গত ১৫ জানুয়ারি। দেখা যাক তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলেছিল।

গত জানুয়ারিতে মুদ্রানীতি দেওয়ার সময় দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। এরপরও টাকার জোগান আরও বৃদ্ধি এবং সরকারকে বেশি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা ছিল মুদ্রানীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ঠিক করা সাড়ে ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন সামনে রেখেই মুদ্রানীতি দিয়েছিল। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা ছিল, তারা ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা কমাবে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠিন করবে এবং পুনঃ অর্থায়ন ও প্রাক্‌-অর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করবে।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেদিন বলেছিলেন, ‘এখনকার মূল্যস্ফীতি টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ, এ মূল্যস্ফীতি আমদানিজনিত। একে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আমাদের হাতে নেই। এ জন্য আমদানি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

দেখা যাচ্ছে, আগের মুদ্রানীতি ছিল পুরোপুরিই ব্যর্থ। কেননা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ জন্য রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের দায় অবশ্যই আছে, আরও আছে সরকারের বেশ কিছু ভুল নীতি। এর মধ্যে কিছু ভুল অতীত থেকে বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ, কিছু ভুল করেছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পরে, অর্থনীতির মৌলিক রীতিনীতি অস্বীকার করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন মুদ্রানীতি কি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারবে? তা হবে না। কিছুটা স্বস্তি হয়তো পাওয়া যাবে। আইএমএফের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের অবস্থান থেকে সরে এলেও এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তা ছাড়া অর্থনীতিতে একাধিক বিকল্প থাকে। সেখান থেকে একটা বেছে নিতে হয়।

এমনিতেই আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংকট অস্বীকার করার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এবার সেই প্রবণতা ছিল বহুমাত্রিক। যেমন প্রথমে বলা হলো এই মূল্যস্ফীতি আমদানি করা। সুতরাং কমাতে হবে আমদানি। এতেই আছে সমাধান। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এ সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে মূলত মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বললেন, যেহেতু মূল্যস্ফীতি আমদানির কারণে, তাই মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে লাভ হবে না।

অর্থনীতির যে সংকটকে বলা হচ্ছে গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়, সে সময়ে অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্বকে অস্বীকার করার সাহস খুব কম দেশই দেখাতে পেরেছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশসহ কিছু দেশ। এর ফলও পাচ্ছে বাংলাদেশসহ এসব দেশ। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, তুরস্কের ৩৯, কেবল টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতি চালানো ভেনেজুয়েলার মূল্যস্ফীতি ৪৩৬, পাকিস্তানের ৩৬, মিয়ানমারের ২০, সুদানের ৮৭ আর আর্জেন্টিনার মূল্যস্ফীতি ১০৮ শতাংশ।

এবার অর্থনীতির কয়েকটি সাম্প্রতিক পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে বিরোধীরা এর নাম দিয়েছিল বাইডেনফ্লেশন। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে এর নাম দেওয়া হয় পুতিনফ্লেশন। তবে বাংলাদেশের যে মূল্যস্ফীতি, তাতে পুতিনের অবদান আছে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে বাইডেন বা অন্যরা যা করেছেন, বাংলাদেশ সে পথে একদমই হাঁটেনি। বরং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করে, সুদহার কমিয়ে এবং সরকারের ঋণ বাড়িয়ে এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে, যাতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাধ্য। ফলে ডেকে আনা এই মূল্যস্ফীতিকে বাংলাফ্লেশন বলাই যায়।

২০২০ সালে সরকার ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। আক্ষরিক অর্থেই সেটি ছিল অর্থনীতিকে ‘নয়-ছয়’ করা। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে সেখান থেকে আর সরে আসতে চায়নি সরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও তা মেনে নেয়। সেই নয়-ছয়ের সিদ্ধান্তের পেছনে যে অর্থনীতি নয়, বরং ছিল রাজনীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর গত রোববার মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় সে কথা স্বীকারও করেছেন।

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘যখন সুদহার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ ছিল, তখন ব্যবসার খরচ কমাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবার বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা সরকারকে এটা বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই আবার ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেওয়া হচ্ছে।’ আগে আমরা অর্থনীতির প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক পেয়েছিলাম, পরে পেলাম রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদহার। সুতরাং ‘রাজনৈতিক সুদ’ বলেও একটি পরিভাষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতেই পারে।

এ প্রসঙ্গে পাঠকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম সেরা অর্থনীতিবিদ, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম ডি রাজনের বই থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। ঋণের সুদহার ও মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘অবমূল্যায়নের ফলে বিনিময় হার কমে গেলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে সুদের হার বৃদ্ধি করতে হবে। ব্রাজিল অথবা রাশিয়ার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, যদি স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্য হয়, তাহলে যথেষ্ট অবমূল্যায়িত বিনিময় হার এবং স্বল্পতর সুদের হার কখনোই একসঙ্গে থাকতে পারে না।’ অথচ বাংলাদেশ সে কাজ করেই সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.