ইনজুরি থেকে ফেরার পরও যে তামিম আগের তামিম ইকবালই আছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ওর নিজের মধ্যে বড় ইনিংস খেলার একটা তাড়না ছিল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম তিন ম্যাচে বড় কিছু করতে না পারায় শেষ ম্যাচটায় কিছু একটা করে দেখানোর বাড়তি তাগিদ ছিল। সেটি ও করলও, যদিও ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরিটা পেল না!
তামিমের সব চিন্তাই আসলে ক্রিকেট নিয়ে, বিশেষ করে ব্যাটিং নিয়ে তো ওর চিন্তার শেষ নেই। গত ম্যাচের আগে যেমন হিসাব করে রেখেছিল, এ ম্যাচে ১০৫ রান করলে ওয়ানডেতে ওর গড় ৩০-এর ঘরে চলে যাবে। এ রকম আগে থেকে হিসাব করে রাখা! আমি এটা কল্পনাই করতে পারি না। খেলা নিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি না ভাবলে কিন্তু চিন্তাটা এত দূর আসে না যে, ১০৫ করলে আমার গড় ৩০-এ পৌঁছাবে।
তবে তামিম সেঞ্চুরি না পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছেন সম্ভবত রাজ (রাজ্জাক) ভাই। ম্যাচের আগে রাজ ভাইকে ও বলেছিল, সেঞ্চুরি করতে পারলে ওনাকে একটা আই ফোন কিনে দিবে। রাজ ভাই তাই শুধু দোয়া করছিলেন, এক শ কর।
তামিমের মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখি না। এই সিরিজের আগে খোকন ভাই-সোহেল ভাইদের (টিম বয়) বলেছিল, ও যদি দুটি সেঞ্চুরি করতে পারে, তা হলে ওনাদের একটা গাড়ি কিনে দেবে। তামিমের সঙ্গে অনেক দিনের বন্ধুত্বের সুবাদে জানি, দুটি সেঞ্চুরি করলে ও সত্যি সত্যি গাড়ি কিনে দিত!
গত তামিমের সঙ্গে প্রথম দেখা বিকেএসপিতে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের একটা ক্যাম্পে। এরপর অনূর্ধ্ব-১৭ আর অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও একসঙ্গে খেলেছি। তবে আমাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয় জাতীয় দলে আসার পর। একজন আরেকজনকে আরও ভালোভাবে জেনেছি তখন থেকেই। ২০০৬ সাল থেকে হিসাব করলে বেশির ভাগ সময় আমরা দুজন একসঙ্গে কাটিয়েছি। খেতে গেলে, কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে…খুব কম সময়ই আছে যখন আমরা একসঙ্গে থাকি না। দুজনের বাসা একই বিল্ডিংয়ে হওয়ায় ব্যাপারটা এখন আরও বেশি হচ্ছে।
মৌসুমে মোহামেডানে ইমন নামে একজন পেস বোলার ছিল। কোনো এক ম্যাচের আগে তামিম ওকে বলেছিল, ওই ম্যাচে ভালো খেললে আই ফোন কিনে দেবে এবং দিয়েছেও শেষ পর্যন্ত। আরও আছে…দলের সঙ্গে অনুশীলনের পর তামিম প্রায়ই গ্রাউন্ডসম্যানদের নিয়ে সেন্টার উইকেটে বিগ হিটের প্র্যাকটিস করে। ওই প্র্যাকটিসে যে তাকে আউট করতে পারে বা ক্যাচ নিতে পারে, তাকে এক হাজার-পাঁচ শ করে টাকা দিতেই থাকে। যতবার ক্যাচ নেয় বা আউট করে, ততবারই টাকা! এ ছাড়া হঠাৎ করে হয়তো কারও বড় কোনো সাহায্য লাগল, তামিমই সবার আগে এগিয়ে আসে। আমি দেখেছি ও এসব করলেই ভালো খেলে।
অথচ দেখুন, আমাদের দুজনের চরিত্রে মিল কিন্তু খুব বেশি নেই। একমাত্র মিল, দুজনই খুব জেদি। যদিও আমাদের মধ্যে সিরিয়াস কোনো গ্যাঞ্জাম বাধেনি কখনো, টুকটাক কিছু হলে কেউ একজন এগিয়ে মিটমাট করে ফেলি। তবে একবার ভালোই লেগেছিল। কী নিয়ে সেটা না-ই বললাম, তবে সেবার কথা-টথাও বন্ধ ছিল অনেক দিন। অভিমান ভাঙল গত বছর জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেদিন আমি ৯২ করলাম, বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল। খেলা শেষে ওকে জড়িয়ে ধরে আমার সে কী কান্না! তখন থেকেই আবার কথা বলা শুরু।
তামিমের আরেকটা বড় গুণ, ও সব সময়ই সতীর্থদের পাশে থাকে। মাঠের ভেতর-বাইরে সবখানে। যেকোনো প্রয়োজনে ওর কাছ থেকেই সবাই পরামর্শ চায়। ধরুন, কেউ একটা গাড়ি কিনবে, তামিমকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘দোস্ত কোনটা কিনলে ভালো হয়?’ তামিমও সঙ্গে সঙ্গে উঠেপড়ে লাগে। কিংবা কোনো পার্টির জন্য কোন রেস্টুরেন্টটা ভালো হবে, তামিমের কাছেই আছে তার উত্তর। আমি হয়তো ঠিক বোঝাতে পারছি না..তবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এসব কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। সবাই এভাবে সাহায্য করে না বা করতে পারেও না।
তবে তামিম যত ভালো মানুষই হোক, আমার সঙ্গে একটা খোঁচাখুঁচি সব সময় লেগেই আছে। ও আমাকে খোঁচায়, ‘টেস্টে তোর কয়টা সেঞ্চুরি রে? আমি পাল্টা বলি, ওয়ানডেতে তোর কয়টা..গড় কত? পরশুও সেটাই ঘটল। ৯৫ করে আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে তো প্রথমে ওর মন-টন খারাপ। তারপর একটু রিল্যাক্স হওয়ার পর আমিই এগিয়ে গেলাম, দোস্ত, তোর সেঞ্চুরি কয়টা হলো রে এ পর্যন্ত?’ সঙ্গে সঙ্গে সে-ও শুরু করে দেয়, ‘সাদা কাপড়ে কয়টা করেছিস?