ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্রিকসের অভিন্ন মুদ্রার কতটা সম্ভাবনা, সংকট-ই বা কী

0
117
ডলার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাণিজ্যে ডি-ডিলারাইজেশন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। অনেক দেশই এখন মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। এর মধ্যে আবার ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো গত এপ্রিল মাসে নতুন রিজার্ভ মুদ্রা চালুর ঘোষণা দিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় নিয়ে বিচার–বিবেচনার অবকাশ আছে। বিষয় দুটি হলো—প্রথমত, ব্রিকস জোটের দেশগুলোর সবার স্বার্থ এক নয়; দ্বিতীয়ত, নতুন মুদ্রার সম্ভাবনা ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা।

ব্রিকস জোটের সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যে নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্যের চিন্তা করছে। কারণ, অভিন্ন মুদ্রা থাকলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যই কেবল বাড়বে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের মুদ্রা ডলারে রূপান্তরের যে উচ্চ ব্যয়, তা থেকেও রেহাই পাবে তারা।

প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো ভারত ও চীনের নেতৃত্বে জাতীয় মুদ্রায় নিজেদের লেনদেন সম্পন্ন করতে চায়। নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু হলে ব্রিকস ডিজিটাল বা বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের কথাও সক্রিয়ভাবে চিন্তা করবে বলে ইঙ্গিত রয়েছে।

ব্রিকস হলো পাঁচটি দেশের জোট। এসব দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়েই এই জোটের নামকরণ হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

তবে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সবাই যে অভিন্ন কারণে এই উদ্যোগে সমর্থন দিচ্ছে, তা নয়, বরং সবার ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থও রয়েছে। রাশিয়া ও চীন রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সুইফট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের। সে কারণে তারা ডলারভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ও পাশ কাটাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। আবার চীন নিজস্ব মুদ্রা রেনমিনবিকে সামনে আনার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের ১৭ শতাংশই এখন রেনমিনবিতে রাখা আছে। ফলে তারা চীনা মুদ্রায় লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের সামনে রাজনৈতিক কারণ না থাকলেও প্রায়োগিক কারণ থেকে তারা এই উদ্যোগে সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। ফলে এসব দেশের আমদানি খরচ বেড়েছে। ডলারের সংকট তো আছেই। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে তাদের যে ঋণ আছে, তা পরিশোধে সংকটে পড়েছে দেশগুলো। এই বিবেচনায় তারা ডলারের বিকল্প মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী।

ফরেন পলিসি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জোসেফ ডব্লিউ সুলিভান বলেছেন, ডলারের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। সেই গত শতকের ষাটের দশক থেকে অনেক দেশ মার্কিন ডলারকে বিশ্ববাণিজ্যের সিংহাসন থেকে উৎখাতের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তা কেবল আলোচনার পর্যায়েই রয়ে গেছে, ফলাফল ছিল শূন্য। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮৪ দশমিক ৩ শতাংশই হচ্ছে ডলারে; মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হয় চীনের মুদ্রা ইউয়ানে।

ব্রিকস দেশগুলো শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে চাইলে ডলারের আধিপত্য অবসানের পথে যে বাধাগুলো তাদের সামনে আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। বর্তমানে ব্রিকস সদস্যরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করছে। যেমন চুক্তির ভিত্তিতে রাশিয়া ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ইউয়ানে হচ্ছে।

কিন্তু রাশিয়া তো সব আমদানি চীন থেকে করে না। ফলে উভয় দেশের মুদ্রায় দ্বিপক্ষীয় বিনিময়ের পর যে বাড়তি আয় রাশিয়ার থেকে যাচ্ছে, সেটা তারা ডলার-সমর্থিত সম্পদে রূপান্তর করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির জন্য এটা তাদের করতেই হয়, কারণ, অন্যান্য দেশ এখনো ডলারেই বাণিজ্য করছে।

সেখানেই ডলারের সুবিধা। বিষয়টি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থা অনেক বড়, যার মধ্যে আছে ব্যাংক, বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্ন করতে পারে। বিনিয়োগকারীরাও নিজেদের নিরাপত্তার কারণে ডলারভিত্তিক বন্ড কিনতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডলার চাইলেই যেকোনো জায়গায় ভাঙানো যায়, এটাও বড় সুবিধা।

ব্রিকসের শক্তি

বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩২ শতাংশ এখন ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর। ফলে ব্রিকস দেশগুলো বাণিজ্যের জন্য শুধু ব্রিকস মুদ্রাই ব্যবহার করবে, এমন চিন্তাকে বাস্তবসম্মত বলেই মনে করেন জোসেফ ডব্লিউ সুলিভান।

প্রথমত, এর মাধ্যমে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য দরকারি মুদ্রা নিজেরাই ছাপাতে পারবে। অর্থাৎ ব্রিকস সদস্যদেশগুলোর অনুমোদন সাপেক্ষে এই অর্থায়ন সহজেই করা সম্ভব হবে। ২০২২ সালে সামষ্টিকভাবে ব্রিকস দেশগুলোর লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার, যার সিংহভাগ জোগান দিয়েছে চীন। ফলে বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রা জোট বাণিজ্যে যে ধরনের স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি, ব্রিকস জোটের তা অর্জনের সম্ভাবনা আছে। এর আগের জোটগুলোর মতো ব্রিকসের মুদ্রা ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী দেশগুলো নিয়ে হবে না, বরং এর সদস্যদেশগুলো অনেক ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে। বিদ্যমান অনেক মুদ্রা জোটের চেয়ে এটা বেশি শক্তিশালী।

২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসেবে ব্রিকস নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) গঠন করে। এনডিবির কনটিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট (সিআরএ) বা তারল্য ব্যবস্থাপনা অনেক দেশকে আকৃষ্ট করে। এসব দেশের বেশ কটি এমনিতেই ডলার–সংকটে ছিল, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার কারণে তারা নীতি স্বাধীনতা হারায়। ফলে এমন অনেক দেশ এনডিবির কাছ খেকে ঋণ নিয়েছে। এ ছাড়া এনডিবি স্থানীয় মুদ্রায় বন্ড ছেড়েছে। এই প্রক্রিয়া ব্রিকসকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক ব্লগে বিশ্লেষক কনিশক শেঠি লিখেছেন, ভারতের ভূমিকা ব্রিকস মুদ্রা চালুর ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাশিয়া নিজস্ব স্বার্থের কারণে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হবে, যদিও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার রুপি-রুবলে বাণিজ্যের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু চীনের প্রতি রাশিয়ার ঝুঁকে থাকার কারণে একধরনের স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে।

অন্যদিকে ব্রিকস জোটে চীন সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবে চীন সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করবে। এতে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যঘাটতি বাড়বে। সেটা নিয়ে আবার তাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হতে পারে।

এ ছাড়া ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যবধান অনেক। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা রান্ডের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রার কতটা দরপতন হবে, সেটার একটা সীমা হয়তো তাদের নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ মুদ্রা ইউনিয়ন গঠনের আগে দেশগুলোকে মুদ্রার অবনমনের বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.