এবার সৌদি যাচ্ছেন বিমানের শত কর্মী, ব্যয় ৯ কোটি টাকা

0
93
বিমান

হজ উপলক্ষে এবার সৌদি আরব যাচ্ছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁরা প্রত্যেকে গড়ে ৩৭ দিন করে সে দেশে অবস্থান করবেন। থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলে প্রতিদিন জনপ্রতি গড়ে ২২০ ডলার খরচ পড়বে। এতে বিমানের মোট খরচ হবে প্রায় ৯ কোটি টাকা। এত টাকা ব্যয়ে এই বিপুলসংখ্যক কর্মী সৌদি পাঠানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিমান সূত্র জানায়, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ২৫ জন হজের আগে পদায়ন (প্রি-হজ পোস্টিং) ও ৭৫ জন হজের পর পদায়ন (পোস্ট-হজ পোস্টিং) নিয়ে যাবেন।

কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা বিমানের ফ্লাইটসূচি ঠিক রাখা, যাত্রীদের লাগেজ (মালামাল) ও হুইলচেয়ার ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করা, টিকিট পরিবর্তন, উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে যাত্রী হাতব্যাগ উড়োজাহাজে পৌঁছে দেওয়াসহ নানা কাজ করবেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানের হজ ফ্লাইটগুলো যাবে জেদ্দা ও মদিনা গন্তব্যে। দুই জায়গাতেই বিমানের নিজস্ব কার্যালয় ও জনবল আছে। এ ছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ‘রুট-টু-মক্কা সার্ভিস’ চুক্তির আওতায় হজযাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও লাগেজ তল্লাশির কাজ ঢাকাতেই সম্পন্ন হবে। হজ-পরবর্তী সার্ভিসের সময় ‘চেক ইন’-এর ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি হবে এজেন্টের মাধ্যমে। তাই এত কর্মীকে পাঠানো অযৌক্তিক ও ডলারের অপচয়।

এবার ১০০ জনকে পাঠানোর বিষয়টা যৌক্তিক। কারণ, হজ ফ্লাইটের জন্য নির্ধারিত টার্মিনালে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে হয় এবং দুই ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আজিম

হজ উপলক্ষে সৌদিতে অস্থায়ী পদায়নপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখা গেছে, বিপণন বিভাগ থেকে যাচ্ছেন ২৭ জন (পোস্ট-হজ পোস্টিং)। এই বিভাগের কাজ মূলত টিকিট পরিবর্তন বা যাত্রার তারিখ পরিবর্তনসংক্রান্ত। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এ কাজের জন্য ৬ জনই যথেষ্ট।

বিমানের এমডির দাবি, এসব কর্মীর পেছনে যত টাকা খরচ হবে, তাঁদের দিয়ে তার চেয়ে বেশি আয় হবে। সে জন্য তাঁদের পাঠানো হচ্ছে।
অতীতে বিমানের হজ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন এমন একাধিক সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই হজ ফ্লাইট ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার জন্য বিমান থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মী পাঠানো হয়। এটাকে একধরনের সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যার কারণে এ ধরনের অস্থায়ী পদায়নের জন্য অনেকে তদবির করে থাকেন। ২০১৯ সালেও বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠানো নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।

হজ-ওমরাহ মৌসুমে টিকিটের দাম বাড়ার পেছনে ‘বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা’
অবশ্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আজিম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, এবার ১০০ জনকে পাঠানোর বিষয়টা যৌক্তিক। কারণ, হজ ফ্লাইটের জন্য নির্ধারিত টার্মিনালে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে হয় এবং দুই ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হয়। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে এবারের চেয়ে কম হজযাত্রী ছিল, তখন পাঠানো হয়েছিল ১১৯ জনকে।

বিমানের এমডির দাবি, এসব কর্মীর পেছনে যত টাকা খরচ হবে, তাঁদের দিয়ে তার চেয়ে বেশি আয় হবে। সে জন্য তাঁদের পাঠানো হচ্ছে।

বিমানের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশের হজযাত্রীর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। তাঁদের অর্ধেক পরিবহন করবে বিমান। বাকিরা যাবেন সৌদি আরবের দুটি এয়ারলাইনসে। ২১ মে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের প্রথম হজ ফ্লাইট জেদ্দার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।

গত বছর গেছেন ৪০ জন
গত বছর বাংলাদেশ থেকে মোট হজযাত্রী ছিলেন ৫৯ হাজার ৩১৮ জন। তাঁদের মধ্যে অর্ধেক পরিবহন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ওই বছর হজের আগে পদায়ন দিয়ে (প্রি-হজ পোস্টিং) বিমানের কোনো কর্মীকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়নি। তবে হজের পরে (পোস্ট-হজ ফ্লাইটের) জন্য ৪২ জনকে পদায়ন করা হয়েছিল। তবে বিমান সূত্রে জানা গেছে, ওই তালিকা থেকে ৪০ জন গিয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিভিন্ন বিধিনিষেধ ছিল। তাই হয়তো প্রি-হজ ফ্লাইটের জন্য কাউকে পাঠানো হয়নি। তখন সময়মতো ফ্লাইটও চালানো যায়নি। যার কারণে এবারের ফ্লাইটসূচি পাওয়ার আগে গত বছরের বকেয়া জরিমানা পরিশোধ করতে হয়েছে।

নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ
বিমানের কর্মীদের দেশের বাইরে বা হজ উপলক্ষে পদায়নের জন্য একটি নীতিমালা আছে। ২০১৯ সালের ২৭ মে এক প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে নীতিমালাটি কার্যকর করে বিমান। ওই নীতিমালার ধারা ‘এ’ অনুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক বা স্থায়ী পদে কোনো কর্মীর চাকরির মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ না হলে তাঁকে হজ উপলক্ষে দেশের বাইরে অস্থায়ী ভিত্তিতে পদায়ন করা যাবে না। এ ছাড়া ‘সি’ ধারা অনুযায়ী, সৌদি আরবে পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মীরা অগ্রাধিকার পাবেন।

অভিযোগ উঠেছে, এবার হজযাত্রা ব্যবস্থাপনার জন্য এই ধারা দুটি মানা হয়নি। তুলনামূলকভাবে নবীন এবং তিন বছর চাকরি করেননি এমন কর্মীদেরও হজ ব্যবস্থাপনার জন্য সৌদি আরবে পদায়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একাধিক কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, প্রশাসনিক আদেশ বা নীতিমালা যদি না মানা হয়, তবে এমন নীতিমালার প্রয়োজন কী?

অবশ্য বিমানের এমডি বলেন, কাজের প্রয়োজনেই তালিকায় দু-একজন নবীন কর্মীকে এবার অস্থায়ী পদায়ন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেই এখতিয়ার আছে।

‘হজ অপারেশনস-২৩’ উপলক্ষে সৌদি আরবে অস্থায়ী লোকবল পদায়নের জন্য ১৭ এপ্রিল দুটি তালিকা করেছিল বিমান। তাতে মোট ৯৫ জনের নাম ছিল। পরে দুটি তালিকা বাতিল করা হয়। এরপর ৩ মে ও ৭ মে নতুন করে তিনটি তালিকা করা হয়। তাতে মোট ১০০ জনের নাম রয়েছে। নতুন তালিকা অনুযায়ী, হজ-পরবর্তী (পোস্ট-হজ) ব্যবস্থাপনায় সৌদিতে পদায়ন পাওয়া ৭৫ জনের নেতৃত্বে থাকবেন বিমানের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, এবারই প্রথম প্রশাসন বিভাগের কেউ হজ ব্যবস্থাপনার জন্য সৌদি আরবে যাচ্ছেন। এ কাজে প্রশাসন বিভাগের কাজটা কী, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে। এ বিষয়ে মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ  বলেন, সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ, তদারকি এবং কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোসহ বিভিন্ন কাজ করবেন তিনি।

তবে এত সংখ্যক কর্মীর সৌদি আরবে যাওয়া প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালক ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, এটা তাঁদের বাৎসরিক আউটিংয়ের (বেড়ানো) মতো। এত লোকের প্রয়োজন নেই। এটি বহুদিন ধরেই বিমানে চলে আসছে, প্রশ্ন করারও কেউ নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.