সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে কোনো পণ্য

0
129
নিত্যপণ্য

রমজান এলেই যেন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন ব্যবসায়ীরা। এবারও ব্যতিক্রম ঘটছে না তার। রমজানের বেশ আগ থেকে মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দমনে সরকার কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে এলেও রমজানে বাজার পরিস্থিতি তথৈবচ। রোজার প্রথম সপ্তাহেই ভোক্তা সাধারণের পকেটে পড়েছে টান। সরবরাহ কম, ভ্যাট বেশি, ডলার সংকট- বিভিন্ন অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েই চলেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

শেষ পর্যন্ত গতকাল শুক্রবার গরুর মাংস, ছোলা, ব্রয়লার মুরগিসহ ২৯ নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয় সরকার। এরপরও শনিবার (১৬ মার্চ) বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগের মতোই বাজার চড়া। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে কিছুই।

বাজারের এমন অব্যবস্থাপনায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ ক্রেতা সাধারণ। তাদের অভিযোগ, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়েই দায় সারছে সরকার। সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে সরকার যে কঠোর হুঁশিয়ারির কথা বলে আসছে তার প্রয়োগ নেই বাজারে। নিয়মিত তদারকি ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখনও লাগামহীন সিন্ডিকেটের হাতেই।

শনিবার (১৬ মার্চ) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল বাজার, শ্যামবাজার, রায়সাহেব ও নয়াবাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা মেলে অব্যবস্থাপনার এই চিত্রের।

বাজারে এখনও গরুর মাংস ৭৮০ টাকা, মুরগির মাংস ৩৫০ টাকা, মসুর ডাল ১৩৫ টাকা, মুগডাল ১৬০ টাকা, পেঁয়াজ ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সবজি ও মাছসহ সবকিছুই আগের মতো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নির্ধারিত দাম না মানার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অজুহাত, অতিরিক্ত গাড়িভাড়া ও ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে দাম কমানো সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি আলু মানভেদে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৮০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, করলা ১০০, পটল ১০০, ঝিঙা ৮০, টমেটো ৬০-৭০ টাকা, শিম ৪০-৬০, শসা ৬০ টাকা, ক্ষিরা ৫০ টাকা, মরিচ ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, পেঁয়াজ ৮০ টাকা, ধনে পাতা ৮০-১০০ টাকা, পেঁয়াজ কলি ৪০ টাকা, আদা ২০০ টাকা ও রসুন ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৩০-৬০ টাকায়।

মাংসের বাজারেও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মাংস। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, খাসির মাংস ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৫০টাকা এবং দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।

মাছের বাজারেও একই অবস্থা। প্রতি কেজি রুই মাছ ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা, কাতল মাছ ৪০০ টাকা, পাঙাস মাছ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২২০ টাকা, পাবদা ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, পোয়া ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, টেংরা মাছ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, পুঁটি মাছ ৫০০ টাকা, মেনি মাছ ৬০০ টাকা, বেলে মাছ ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় মাছ ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, চিতল মাছ ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে শনিবার।

এ ছাড়া প্রকারভেদে প্রতি কেজি মুগডাল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, মুসুর ডাল ১১০ থেকে ১৩৫ টাকা, মটরডাল ১৬০ টাকা, খেসারি ডাল ১৪০ টাকা এবং ছোলা ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল, প্রতি কেজি চিনি টাকা। চড়ামূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডিমও। প্রতি ডজন মুরগির ডিম ১৩৫-১৮০ টাকা ও হাঁসের ডিম ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে বাজারভেদে।

সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন সে ব্যাপারে জানেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার দাম বেঁধে দিলেও আগের দামেই পণ্য কিনতে হচ্ছে তাদের। তার সঙ্গে আছে শ্রমিক খরচ, গাড়িভাড়া, খাবার খরচ। সব মিলিয়ে বেশি দামেই পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা বলেন, আড়তদার যে দাম রাখে তার ওপর নির্ভর করে তারা বিক্রি করেন। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ভালো কথা। কিন্তু তারাও যেন সঠিক দামে পণ্য কিনতে পারেন সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা দরকার।

এদিকে শনিবার কারওয়ান বাজারে সদাই কিনতে আসা মফিজুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিলেই তো ব্যবসায়ীরা মানছে না। বেঁধে দেওয়া দামে যেন তারা পণ্য বিক্রি করেন, সেজন্য কঠোর নজরদারি দরকার। সিন্ডিকেট নিয়ে শুধু হুঁশিয়ারিই শুনি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সিন্ডিকেট করে কারা, তাই জানতে পারলাম না।

লাগামহীন সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরবরাহ ও চাহিদা বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। মুক্তবাজারের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে নির্ধারণ করে দিয়ে মূল্য কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেটা বন্ধে সরকারকে আগে নজর দিতে হবে৷

প্রসঙ্গত, শুক্রবার সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিমের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ এর ৪ (ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত দামে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অনুরোধ করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে গরুর মাংস, ছোলা, ব্রয়লার মুরগিসহ ২৯টি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

এদিকে রমজানের বাজারে বাড়তি মুনাফা কামিয়ে নিতে চালবাজিতে মেতে উঠেছে চালকল মালিকরাও। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে হুট করে গরিবের সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০-২০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও। পেটে এক মুঠো ভাত জুটাতে গিয়ে চোখে সরষে ফুল দেখছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

অটোরাইস মিল মালিক সমিতি সূত্র বলছে, ধান থেকে চাল তৈরিতে ব্যাঘাত হওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে একটু। এছাড়া সরকার চাল কিনে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করছে ও সহায়তা কর্মসূচির আওতায় সাধারণ মানুষকে দিচ্ছে। এ কারণে দাম তুলনামূলক বাড়ছে।

মিল মালিক সমিতির এই খোঁড়া যুক্তির ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না খোদ পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের চাল ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, রোজার মাসকে টার্গেট করে যৌক্তিক কোনও কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহ দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কয়েকদিন ধরে মিল পর্যায় থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না। যে পরিমাণ চাল অর্ডার করা হচ্ছে, দিচ্ছে তার কম। এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে মিল মালিকরা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চালের দাম কেন বেড়েছে, তা তদারকি করে বের করা হবে। মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি করা হবে। অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.