বাজারের কম দামের সবজিগুলোর একটি পটোল। বর্ষায় ইলিশের সঙ্গে পটোলের তরকারি জনপ্রিয়। এবার ইলিশ কেনার উপায় নেই। দাম আকাশছোঁয়া। পটোলের দামও কম নয়। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতি কেজি পটোল এখন ৬০ থেকে ৮০ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি।
শুধু পটোল নয়, বেশির ভাগ সবজির দাম এবার বেশি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের বাজারদরের দৈনিক তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ২১ আগস্টের চেয়ে এ বছরের ২১ আগস্ট (গত বৃহস্পতিবার) ১৬টি সবজির দাম গড়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
প্রতিবছর জুলাই ও আগস্টে বৃষ্টি ও বন্যায় সবজির খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দামও বেড়ে যায়। বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমানও সে কথাই বলেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষা শেষের এই সময়ে শাকসবজির দাম একটু বেশি থাকে। রবিশস্য আসার আগে এমনটা মেনে নিতে হবে। তবে বাজার যাতে ঠিক থাকে, সে জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
কারওয়ান বাজারে রাতে পাইকারিভাবে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দরে বিক্রি হয় খুচরা পর্যায়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম ৩০ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ এবং কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বা তার বেশি বাড়ে।
অবশ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, বর্ষার স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে এবার সবজির দাম বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এবার আগস্টে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি কম হয়েছে।
সবজির সঙ্গে বেড়েছে মাছ ও মাংসের গড় দামও। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, পাঁচটি মাছের দাম বেড়েছে গড়ে ১৮ শতাংশ। মাংস ও ডিম শ্রেণিতে গড় মূল্যবৃদ্ধি ৭ শতাংশ।
সবজি, মাছ ও মাংস মানুষ নিয়মিত কেনে। এগুলোর দাম বাড়লে তা সংসারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়। এখন চাল, ডাল ও তেলের দাম চড়া। সঙ্গে সবজি ও মাছের দর মানুষকে আরও চাপে ফেলছে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেনকে বৃহস্পতিবার পাওয়া যায় স্থানীয় একটি গলিতে, যেখানে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি হয়। তিনি তিনটি মাঝারি বেগুন কিনছিলেন। দাম পড়েছিল ৬০ টাকা। তিনি জানালেন, এবার আগস্ট মাসের প্রথম ১৯ দিনে একটি ইলিশও কেনেননি। কারণ, দাম অত্যধিক চড়া। মৌসুমও শেষের পথে। অবশেষে বৃহস্পতিবার তিনি আধা কেজি ওজনের একটি ইলিশ কেনেন ৮০০ টাকা দিয়ে।
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আধা কেজির ইলিশ আগে মোটামুটি ৪০০ টাকায় কেনা যেত। এখন দাম দ্বিগুণ। সঙ্গে বেগুনের দামও দ্বিগুণ হয়েছে। কেজি ১২০ টাকা। তিনি আরও বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ মাছ কিনতে পারবে না, মাংস কিনতে পারবে না, ডিম কিনতে পারবে না, সবজি কিনতে পারবে না—তাহলে খাবেটা কী?’
প্রতিবছর বর্ষা শেষের এই সময়ে শাকসবজির দাম একটু বেশি থাকে। রবিশস্য আসার আগে এমনটা মেনে নিতে হবে। তবে বাজার যাতে ঠিক থাকে, সে জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান

কোন সবজির দাম কতটা
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় বাজারদরের তালিকায় দেখা যায়, ১৬টির মধ্যে এবার ১৪টি সবজির সর্বনিম্ন দাম ৫০ টাকা বা তার বেশি। সেগুলো হলো বেগুন, চিচিঙ্গা, কচুমুখী, বরবটি, লাউ (প্রতিটি), পটোল, ঢ্যাঁড়স, শসা উচ্ছে/করলা, কচুর লতি, চালকুমড়া (প্রতিটি), কাঁকরোল, ঝিঙে ও ধুন্দুল। গত বছর ৫০ টাকা বা বেশি সর্বনিম্ন দর ছিল সাতটি সবজির।
এবার দুটি সবজি পাওয়া যাচ্ছে ৫০ কেজির কমে—মিষ্টিকুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও কাঁচা পেঁপে ২০ থেকে ৩০ টাকা। গত বছর ৯ ধরনের সবজির সর্বনিম্ন দর ছিল ২৫ থেকে ৪৫ টাকা।
এসবের বাইরে এবার আলুর দাম বেশ কম। ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। আলুর দাম কমে যাওয়ায় অবশ্য কৃষক লোকসানে পড়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
তিনি জানালেন, এবার আগস্ট মাসের প্রথম ১৯ দিনে একটি ইলিশও কেনেননি। কারণ, দাম অত্যধিক চড়া। মৌসুমও শেষের পথে। অবশেষে বৃহস্পতিবার তিনি আধা কেজি ওজনের একটি ইলিশ কেনেন ৮০০ টাকা দিয়ে।
কারণ কী
ঢাকার কারওয়ান বাজারে রাতে সবজি নিয়ে আসেন ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার রাতে ও গতকাল দুপুরে কারওয়ান বাজারের আটজন ফড়িয়া ও আড়তকর্মীর সঙ্গে কথা বলে সবজির মূল্যবৃদ্ধির কয়েকটি কারণ জানা যায়। প্রথমত, বৃষ্টিতে সবজির খেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকেই বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এ কারণে সরবরাহ কমেছে, দাম বেড়েছে।
এ বিষয়ে বগুড়া থেকে বরবটি নিয়ে আসা ফড়িয়া রিপন আলী বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বলেন, বৃষ্টি-বর্ষায় খেত নষ্ট হয়ে গেছ। গাছের গোড়ায় পানি উঠে পচে গেছে, সে জন্য এখন বরবটির সরবরাহ কম। দাম একটু বেশি।
এবার আগস্টে বৃষ্টি কতটা হয়েছে, তা জানতে খোঁজ নেওয়া হয় আবহাওয়া অধিদপ্তরে। সংস্থাটির আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন, গত বছরের আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বৃষ্টি বেশি হয়েছিল। মাস শেষ না হওয়া এবার আগস্টের বৃষ্টির হিসাব এখনো তৈরি হয়নি। তবে ২১ আগস্ট পর্যন্ত বৃষ্টি ১৩ শতাংশ কম হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহিনুল ইসলাম বলেন, যতটা মনে হচ্ছে, এখনো এই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি।
সবজির মূল্যবৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন, গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন বেশ কিছুদিন চাঁদাবাজি, পরিবহন ও বাজারকেন্দ্রিক ‘সিন্ডিকেট’ ছিল না। এতে সবজির দাম কমে গিয়েছিল। এখন আবার আগের অবস্থা হয়েছে। তৃতীয়ত, বেশ কিছু মহাসড়কের পরিস্থিতি ভালো নয়। রাস্তা খারাপ হওয়ায় চলাচলে বেশি সময় লাগছে। এ কারণে ট্রাকভাড়াও কিছুটা বেশি চাওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজারের একজন ফড়িয়া বলেন, একজন সবজি নিয়ে আসার পর ট্রাকে থাকা অবস্থাতেই বিক্রি হয়। আরেকজন কিনে নেন। এভাবে হাতবদলে দাম বাড়ে। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছুদিন এসব ছিল না।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) গত ২৯ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, যথাযথ তথ্যের অভাব, চাঁদাবাজি ও পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচের কারণে খুচরা বাজারে সবজির দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
রাতে ৮০ টাকা, সকালে ১৬০
কারওয়ান বাজারে রাতে পাইকারিভাবে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দরে বিক্রি হয় খুচরা পর্যায়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম ৩০ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ এবং কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বা তার বেশি বাড়ে।
যেমন বৃহস্পতিবার রাতে কারওয়ান বাজারে ভালো মানের সাদা গোল বেগুনের কেজি ৮০ টাকার আশপাশে বিক্রি করতে দেখা যায়। গতকাল দুপুরে কারওয়ান বাজারের আড়তের পাশেই সবজির ভ্রাম্যমাণ দোকানে একই বেগুনের কেজি চাওয়া হচ্ছিল ১৬০ টাকা।
কারওয়ান বাজার থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো দূরে জোয়ারসাহারা বাজারেও সাদা বেগুন ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।
দাম বাড়ছে, সেটা আমরা জানি। আসলে কী কারণে দাম বাড়ছে, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তার জন্য বিস্তৃত গবেষণা দরকার।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান
মাছ-মাংসের দামও বেড়েছে
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রুই, কাতলা, ইলিশ, পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছের দামের হিসাব দেয়। তাতে দেখা যায়, এই পাঁচ মাছের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ।
গরুর মাংসের দাম বাড়েনি। যদিও আগে থেকেই চড়া। ছাগলের মাংসের দাম সামান্য বেড়েছে। দেশি, সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। ডিমের দাম সাম্প্রতিককালে বাড়লেও তা গত বছরের ২১ আগস্টের তুলনায় কিছুটা কম। সব মিলিয়ে মাংস ও ডিম শ্রেণিতে গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ।
গতকাল শুক্রবার ‘বিশ্ববাজারে পণ্যের দরপতন, বাংলাদেশে সুফল কম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ের চেয়েও কমেছে। দেশে তার সুফল কম পাওয়া যাচ্ছে। এবার দেখা গেল, দেশে উৎপাদিত সবজি, মাছ ও মাংসের দামও অনেকটাই বেড়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘দাম বাড়ছে, সেটা আমরা জানি। আসলে কী কারণে দাম বাড়ছে, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তার জন্য বিস্তৃত গবেষণা দরকার। এত দিন যা হয়েছে, তা অস্থায়ী ভিত্তিতে হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো ও পরিস্থিতি বুঝতে একটি স্থায়ী কৌশলও থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, সবজি, মাছ ও মাংসের মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধনীদের হয়তো কোনো অসুবিধা হয় না।’
রাজীব আহমেদ ও মো. মামুন, ঢাকা