এ ছাড়া স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের চারটি প্রকল্পে অর্থ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। মূলত ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে এসব প্রকল্পের অর্থ বাংলাদেশকে দেয় বিশ্বব্যাংক। এভাবেই এ দেশে বিশ্বব্যাংকের যাত্রা শুরু।
বিশ্বব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বেশি। ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা ছিলেন সাবেক ইউএস সেক্রেটারি অব ডিফেন্স। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বেশি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ত্বরিত গতিতে বিশ্বব্যাংকের সদস্য ও সহায়তা পেয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব ছিল মার্কিন ও সোভিয়েত বলয়ে বিভক্ত। তাই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে সদস্য বানিয়েছিল। সে সময় মার্কিন বলয়ে নেওয়ার জন্য সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্য বানানোর চেষ্টা থাকত।
পাঁচ দশকে যা হয়েছে—
- পাকিস্তানের ঋণের দায় নিয়ে দর-কষাকষিতেই সফল বাংলাদেশ
- ৫ কোটি ডলারে শুরু, এই পর্যন্ত দিয়েছে ৩৯০০ কোটি ডলার
- বর্তমানে ১৬০০ কোটি ডলারের ৫৭টি প্রকল্প চলমান
- বড় ধাক্কা—পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়া বিশ্বব্যাংকের টাকায়…
- ১৬০০ কিলোমিটার পল্লি সড়ক নির্মাণ
- ১০০০ সাইক্লোন শেল্টার, ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ
- ২৬৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হয়েছে
- বড় অবকাঠামো—বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুনা সেতু) ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন)
এভাবেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাংক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। পাঁচ কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে এ দেশের সঙ্গে সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে সংস্থাটির ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার সহায়তাপুষ্ট ৫৭টি প্রকল্প চলমান। এমন প্রেক্ষাপটে ২২ জানুয়ারি এ দেশে বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ দেশে অবকাঠামো, জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সংস্কারে বিশ্বব্যাংক বড় ভূমিকা রেখেছে। সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং যমুনা সেতু—বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট এ দুটি প্রকল্প ছিল রূপান্তরমূলক, যা আর্থসামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। আর পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়া হলো সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পথচলায় সফলতার সঙ্গে সঙ্গে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো—
পাকিস্তানের ঋণের দায়ের দর-কষাকষিতে সফল বাংলাদেশ
স্বাধীনতার পরপর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি সফল দর-কষাকষি করে বাংলাদেশ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণের দায়ভারের কিছুটা অংশ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিতে চাপ সৃষ্টি করেছিল বিশ্বব্যাংক।
স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাদের ঋণের দায়দেনা নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের দায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে কতটা নিতে হবে, এ নিয়ে চলে দীর্ঘ আলোচনা। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে দাতারা চেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর বেশি ঋণের দায় চাপাতে। কিন্তু বাংলাদেশ এত ঋণের দায় নিতে রাজি ছিল না। বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তি ছিল—বৈষম্যের কারণেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে। ওই সব ঋণের সুফল বাংলাদেশ পায়নি।
এই দায়দেনা নিয়ে কী ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে তৎকালীন সরকার তিন সদস্যবিশিষ্ট ঋণ কমিটি গঠন করেছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ওই কমিটিতে ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং ওই কমিটির দর-কষাকষির সক্ষমতায় একটি ভালো আপসরফা হয়েছিল। দীর্ঘ তিন বছরের আলোচনা শেষে ৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের দায় নিতে রাজি হয় বাংলাদেশ, যা দাতাদের পক্ষ থেকে নেতৃত্বদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের হিসাবের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ।
পদ্মা সেতু নিয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে গত পাঁচ দশকের সম্পর্ক সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে। পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল সংস্থাটির। ওই ঋণ পাওয়া গেলে কোনো একক প্রকল্পে সেটি হতো বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন। কিন্তু দুর্নীতি হতে পারে, এমন অভিযোগ এনে ২০১১ সালে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। পরে অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও কানাডার আদালত—কোথাও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৩২ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে।
৫০ বছরের পথ চলায় অর্জন
সত্তরের দশকে মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রকল্পেই বেশি অর্থায়ন করেছে সংস্থাটি। আশির দশকে কৃষি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে বিশ্বব্যাংক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্থাটি এ দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাত সংস্কারে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে দুটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প হয়। এ দুটি প্রকল্প হলো বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুনা সেতু) এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন) নির্মাণ।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশের ২৬টি জেলায় মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পল্লি সড়ক নির্মাণ করা হয়। বিদ্যুৎ খাতেও বিশ্বব্যাংকের অবদান আছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প দিয়ে এ পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে প্রায় ২ হাজার ৬৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কয়েক দশক ধরে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এখন একটি সফল প্রকল্প। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এক হাজারের বেশি সাইক্লোন শেল্টার বানানো হয়েছে সংস্থাটির অর্থায়নে। এ ছাড়া ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
সফরে আসছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগামী সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) এক্সেল ভন টর্টসেনবার্গ ঢাকায় আসছেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় কর্তা ব্যক্তি। এক্সেল ভন টর্টসেনবার্গের সঙ্গে থাকবেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার।
২২ জানুয়ারি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ আলোচনা সভায় অংশ নেবেন তাঁরা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশেষ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। ওই দিন বিকেলে বিশ্বব্যাংকের এমডি সংবাদ সম্মেলন করবেন।
এ ছাড়া সফরকালে বিশ্বব্যাংকের এমডি এক্সেল ভন টর্টসেনবার্গ সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। জানা গেছে, ওই সব বৈঠকে বাজেট সহায়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ অর্থ কাজে লেগেছে দারিদ্র্য বিমোচনে। রাস্তাঘাট, ভবনসহ বড় অবকাঠামো নির্মাণেও অর্থ দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বব্যাংক দশকের পর দশক অর্থ দিয়ে আসছে।