সড়কের ঠিকাদারি কাজে এক বিস্ময়ের নাম ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)। ২০১৭ সালের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটি সড়কে কাজ শুরু করে। মাত্র ছয় বছরে তারা সড়কে একক ও যৌথভাবে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছে, যা মোট কাজের ১০ শতাংশ।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সাতজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনডিই ঠিকাদারি কাজ পেতে আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করত। ওবায়দুল কাদের কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছিলেন যে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত এক যুগে সওজের ঠিকাদারি কাজের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে এনডিইর মতো ১৫টি প্রতিষ্ঠান ব্যয়ের দিক দিয়ে মোট কাজের ৯০ শতাংশ পেয়েছে। এক যুগে সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ একক ও যৌথভাবে পেয়েছে ওই ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
ঠিকাদারি কাজ পাওয়া, নিম্নমানের কাজ করে টাকা তুলে নেওয়া এবং বেশি কাজ করা দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়…বিগত সরকারের আমলে ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল দুর্নীতির মহামারি।
সামছুল হক, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঠিকাদারি কাজ পাওয়া, নিম্ন মানের কাজ করে টাকা তুলে নেওয়া এবং বেশি কাজ করা দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়—এগুলোর জন্য ঠিকাদারেরা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের হাতে রাখতেন। এটা বিগত সরকারের আমলে ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল দুর্নীতির মহামারি।
সওজের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ১ হাজার ১০০টি; কিন্তু মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে ৯০ শতাংশ কাজ পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সওজের প্রকৌশলীরা বলছেন, এসব ঠিকাদার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের ‘আশীর্বাদে’ ছিলেন। যদিও ঠিকাদারদের কেউ কেউ বলছেন, নেতাদের আশীর্বাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও সওজের কর্মকর্তাদের ‘কমিশন’ দিতে হতো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিলেই তাঁদের অবৈধ আয় বেরিয়ে আসবে।
সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, এনডিই, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এম/এস সালেহ আহমেদ, এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।
কাজ পেতে জালিয়াতি ও অনিয়ম প্রকাশ পাওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে শীর্ষ ১৩টি ঠিকাদারি (স্পেক্ট্রা ও এম এম বিল্ডার্স ছাড়া) প্রতিষ্ঠান ছিল।
সওজ সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সড়কের ঠিকাদারি কাজ তিনটি পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করত: ১. আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা–সংসদ সদস্য। ২. সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্বজন ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজন এবং ৩. সওজের কয়েকজন প্রকৌশলী। ২০১১ সালে ওবায়দুল কাদের সড়কমন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে ধীরে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা, ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের ও নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর চক্র গড়ে ওঠে।
২০২১ সালে কাদের মির্জা নিজের ভাই, ভাবি ও একরাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সারা দেশে আলোচিত হন। সাবেক সড়কমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ঠিকাদারি কাজের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই কাদের মির্জার সঙ্গে ওবায়দুল কাদের ও তাঁর স্ত্রীর বিরোধ তৈরি হয়। পরে অবশ্য দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য দূর হয়। মন্ত্রণালয় ও সওজে আবার তদবিরের সুযোগ ও ঠিকাদারি কাজ পেয়ে চুপ হয়ে যান কাদের মির্জা।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, আসলে বিগত সরকারের আমলে কাকে কাজ দেওয়া হবে, তা আগে ঠিক করা হতো। এরপর দরপত্র ডাকার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো। তিনি বলেন, এটা আর চলবে না। প্রতিযোগিতা বাড়াতে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হবে। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তিনি একটি বিস্তৃত তদন্ত করার কথাও ভাবছেন।
সওজ সূত্র বলছে, শেখ সেলিমের প্রভাবে সর্বশেষ গত নভেম্বরে গোপালগঞ্জে ১৩৭ কোটি এবং ঢাকায় গত বছরের অক্টোবরে ২৪২ কোটি টাকার কাজ পান শফিকুল। ঢাকার কাজটিতে তাঁর অংশীদার তাঁর বাবা শামসুল আলমের প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স।
নেতাদের আশীর্বাদে তাঁরা বড় ঠিকাদার
সড়কে ১২ বছরে সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ পাওয়া ঠিকাদার হাসান টেকনো বিল্ডার্স। তারা পেয়েছে ১১ হাজার ১১৮ কোটি টাকার কাজ। দ্বিতীয় রানা বিল্ডার্স, তারা পেয়েছে ১০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কাজ।
হাসান টেকনোর মালিক নাজমুল হাসান। রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলম। তাঁরা দুজন মামা-ভাগনে। বাড়ি কুমিল্লায়। নাজমুল হাসান কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। জালিয়াতির অভিযোগে দুটি প্রতিষ্ঠানই নিষিদ্ধ হয়েছে।
হাসান টেকনোর মালিক নাজমুল হাসান বলেন, তাঁরা সব কাজ প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম দামে পেয়েছেন। বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
অন্যদিকে রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলম বলেন, তিনি চার দশক ধরে সওজে ঠিকাদারি করেন। যোগ্য বলেই কাজ পেয়েছেন। যৌথভাবে কাজ করতে গিয়ে অন্য ঠিকাদারের ভুলে নিষিদ্ধ হয়েছেন।
মো. আলমের ভাতিজা জুলফিকার হোসেনের (মাসুদ রানা) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মাসুদ হাইটেক। প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ পাওয়া ঠিকাদারের মধ্যে এটি অষ্টম।
জুলফিকারের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ জুয়েল ও নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সখ্য রয়েছে বলে সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আমরা ব্যবসায়ী, তারিক সিদ্দিককে লাগে না। খালেদা জিয়াও আমার আত্মীয়।’ তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা গণপূর্তের কাজ বেশি করেছেন। পরে সড়কে এসেছেন। সরকারি প্রাক্কলনের চেয়ে কম টাকায় দরপত্র দিয়ে তাঁরা কাজ পেয়েছেন।
এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মুস্তাফিজ
সওজর তথ্য বলছে, এনডিই সড়কে মাত্র ছয় বছর কাজ করে এক যুগে সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসে। জাল ও ভুয়া নথি জমা দিয়ে ঠিকাদারি কাজ নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়ে গত ৬ জুলাই ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এনডিইকে। তখন তারা উচ্চ আদালতে যায়। আদালত নিষিদ্ধ করার ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
সাগর ইনফো বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কে ৩৯টি কাজ করেছে। সওজ সূত্র বলছে, এর সব কটিই এনডিইর সঙ্গে যৌথভাবে করেছে তারা। এটিও তারিক আহমেদ সিদ্দিকের আশীর্বাদপুষ্ট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মুস্তাফিজ বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী, তারিক সিদ্দিককে লাগে না। খালেদা জিয়াও আমার আত্মীয়।’ তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা গণপূর্তের কাজ বেশি করেছেন। পরে সড়কে এসেছেন। সরকারি প্রাক্কলনের চেয়ে কম টাকায় দরপত্র দিয়ে তাঁরা কাজ পেয়েছেন।’
অবশ্য অভিযোগ আছে, সড়কে যাঁদের কাজ দেওয়ার চেষ্টা থাকে, তাঁদের সরকারি প্রাক্কলন আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তিনি কাজ পান। দরপত্রের শর্তও পছন্দের ঠিকাদারের যোগ্যতার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়।
বেশি কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চতুর্থ মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল ইসলাম। বাগেরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য ও শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি। মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার কাজ করেছে। এর বড় অংশ খুলনা অঞ্চলে।
সর্বোচ্চ কাজ পাওয়ার তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড। তারা কাজ পেয়েছে ৬ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার। সপ্তম স্থানে রয়েছে মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৪ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকার কাজ। সওজ সূত্র জানায়, এই দুজন ঠিকাদার সওজের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে কাজ বাগিয়ে নিতেন। তাঁরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যখন যাঁকে দরকার ব্যবহার করতেন।
সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দশম অবস্থায় থাকা এম এস সালেহ আহমেদ ২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের নাম সালেহ আহমেদ (বাবুল)। তিনি ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ঘনিষ্ঠ। সওজের কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিষ্ঠানটি আসলে নিজাম হাজারীই চালাতেন।
রিলায়েবল বিল্ডার্স ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ করেছে। এর মালিক শফিকুল আলম (মিথুন)। তিনি সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় ১২তম স্থানে রয়েছেন। শফিকুল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সওজ সূত্র বলছে, শেখ সেলিমের প্রভাবে সর্বশেষ গত নভেম্বরে গোপালগঞ্জে ১৩৭ কোটি এবং ঢাকায় গত বছরের অক্টোবরে ২৪২ কোটি টাকার কাজ পান শফিকুল। ঢাকার কাজটিতে তাঁর অংশীদার তাঁর বাবা শামসুল আলমের প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স।
সওজের সূত্র জানায়, মির্জা আজম ছাড়াও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে তমার মালিকের সুসম্পর্ক ছিল। ফলে ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার পর তমা সওজে বেশ কিছু কাজ পায়।
সংস্থাটির দুজন কর্মকর্তা বলেন, জালিয়াতি ধরা পড়ার পর চলতি বছরের শুরুতে রিলায়েবলকে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিলে তা ঠেকাতে শেখ সেলিম কয়েক দফা ফোন করেছিলেন।
ঠিকাদারি কাজ বাগাতে মডেলদের দিয়ে তদবির করানোর অভিযোগও রয়েছে। ২০২১ সালে একজন মডেলের কাছ থেকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি জব্দ করা হয়। এটির নিবন্ধন ছিল রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে।
সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে ১৩তম অবস্থানে তমা কনস্ট্রাকশন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেল, স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত, নৌসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিপুল কাজ পেয়ে আলোচিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। এর মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। বিগত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে যুক্ত বলে আলোচনা আছে। যদিও তা সব সময় অস্বীকার করে আসছেন আতাউর রহমান। সড়কে ১২ বছরে তমা কাজ পেয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার।
সওজের সূত্র জানায়, মির্জা আজম ছাড়াও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে তমার মালিকের সুসম্পর্ক ছিল। ফলে ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার পর তমা সওজে বেশ কিছু কাজ পায়। ২০২০ সালের শেষ দিকে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একরাম চৌধুরীর সম্পর্কের অবনতি হয়। তমার মালিক আতাউর রহমানকে প্রতিপক্ষ একরাম চৌধুরীর লোক আখ্যা দিয়ে তাঁকে সওজের কাজ না দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের। তবে বছর দেড়েকের মধ্যে তাঁদের মনোমালিন্য দূর হয় এবং তমা সওজের কাজ পাওয়া শুরু করে।
সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪তম অবস্থানে মাহফুজ খান লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। মাহফুজ খান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ। সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র থাকার সময় বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন মাহফুজ খান।
আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের অবস্থান ১৫তম। এর মালিক আবেদ মনসুরের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি বিলবোর্ড, ব্যানার ও বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করতেন। টেলিভিশন নাটকও প্রযোজনা করেছেন। সে সময়ই সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। ওবায়দুল কাদের ও আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে একান্ত অনেক ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেন আবেদ মনসুর।
২০১৮ সালের দিকে সওজে ঠিকাদারি শুরু করেন আবেদ মনসুর। সে সময় ওবায়দুল কাদের সড়কে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতেন এবং আবেদ মনসুরকে সঙ্গে দেখা যেত। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন আবেদ। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে ভোট করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ছয় বছরে আবেদ মনসুর সড়কে ১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুতে অভিজ্ঞতার জাল সনদ জমা দিয়ে কাজ পেয়েছেন তিনি।
শীর্ষ তালিকায় না থাকলেও জে এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কে আলোচিত। সাম্প্রতিককালে তারা সড়কে প্রায় ১৯৭ কোটি টাকার ১০টি কাজ পায়। প্রতিষ্ঠানটির পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচিত ‘পিয়ন’ জাহাঙ্গীর আলম রয়েছেন বলে সওজ সূত্র জানিয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওবায়দুল কাদের, কাদের মির্জা, নিজাম হাজারী, একরাম চৌধুরী, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, বাহাউদ্দিন বাহারসহ প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদেরের বক্তব্য নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এদিকে শীর্ষ ঠিকাদারদের কেউ কেউ বঞ্চিত সেজেছেন। গত ১৮ আগস্ট সওজর প্রধান প্রকৌশলীকে ১০ দফা দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেন বঞ্চিত দাবি করা ঠিকাদারেরা। এতে নয়জন ঠিকাদার সই করেন, যার মধে৵ পাঁচজন সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়াদের তালিকায় রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো হাসান টেকনো বিল্ডার্স, এনডিই, রিলায়েবল বিল্ডার্স, মাসুদ হাইটেক ও এম এস সালেহ আহমেদ। ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য সওজের যে দপ্তর কাজ করেছে, সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে গত মাসের শুরুতে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলি করা হয়েছে। ঠিকাদারদের ১০ দফা দাবির অন্যতম ছিল এই কর্মকর্তাকে বদলি করা।
বাকি চার হাজারের মতো দরপত্রের মূল্য ছিল প্রতিটি ১ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি মূল্যের। তিনজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো প্রকল্পে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ রাজনীতিবিদ ও প্রকৌশলীদের কমিশন দিতে ব্যয় হয়। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ঘুষ ও চাঁদার পেছনেও অর্থ ব্যয় হয়।
‘স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত করা জরুরি’
২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সড়কে দুর্নীতির উৎস ও কারণ প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন সড়ক মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সুপারিশ বাস্তবায়নে সড়ক বিভাগকে নির্দেশনা দেয়। যদিও তাতে কান দেয়নি সড়ক মন্ত্রণালয়।
সওজ গত এক যুগে ৪০ হাজারের বেশি দরপত্র আহ্বান করেছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩৬ হাজার দরপত্রের মূল্য ছিল প্রতিটি এক লাখ থেকে এক কোটি টাকার মধ্যে। এতে মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট এই কাজের নামে আসলে লুটপাট করা হয়।
বাকি চার হাজারের মতো দরপত্রের মূল্য ছিল প্রতিটি ১ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি মূল্যের। তিনজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো প্রকল্পে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ রাজনীতিবিদ ও প্রকৌশলীদের কমিশন দিতে ব্যয় হয়। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ঘুষ ও চাঁদার পেছনেও অর্থ ব্যয় হয়।
ঘুষ গ্রহণ, কাজ পেতে অবৈধভাবে সহায়তা করা ও জালিয়াতির সুযোগ করে দেওয়ার দায়ে সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন সামছুল হক। তিনি বলেন, এর জন্য একটা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত করা জরুরি।
আনোয়ার হোসেন, ঢাকা