দলের ব্যবস্থা অনুযায়ী এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সংবিধানের এই বিধি কৌতূহলোদ্দীপকও বটে। এটি ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানে তৈরি করা হয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেটি বহাল ছিল না, কেননা তখন দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা ছিল।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর। ১৯৭৫ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন সরাসরি নাগরিকদের ভোটে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হলে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার বিধান ফিরে আসে।
ফিরে দেখা
সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থাটি বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা হয় ১৯৭২ সালে। গণপরিষদ সংবিধান রচনা ও গ্রহণের কাজ হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর, যা কার্যকর করা হয় ১৬ ডিসেম্বর। এই সময়ে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থাই জারি ছিল এবং দেশ শাসিত হয়েছিল ১১ জানুয়ারি ঘোষিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২-এর আওতায়। স্মরণ করা দরকার, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যাঁরা ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই কাঠামোতে একজন উপরাষ্ট্রপতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসার পর ১১ জানুয়ারি তাঁর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সরকারের কাঠামো বিষয়ে আলোচনা হয়।
একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ও লেখক মঈদুল হাসানের ভাষ্য অনুযায়ী, এই বৈঠকে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা এবং তাঁর রাষ্ট্রপতি থাকার পক্ষেই ছিলেন; কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে এই মর্মে রাজি করান যে সংসদীয় ব্যবস্থায় শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া দরকার (মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, ঢাকা: ইউপিএল, ১৯৯৫, পৃ.২৩৮)। পরদিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব প্রধান বিচারপতি হিসেবে আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে নিয়োগ দেন এবং শপথবাক্য পাঠ করান। তারপর তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিসভা আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেয়। লক্ষণীয় যে সেই সময় উপরাষ্ট্রপতি পদের বিধান রাখা হয়নি। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। রাষ্ট্রপতি চৌধুরী গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানালে ওই দিন বিকেলে তিনি ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং রাষ্ট্রপতি চৌধুরী তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করান।
বাংলাদেশের সংবিধান বহাল হওয়ার সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। নতুন সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরীকেও নতুন করে শপথ নিতে হয়।
১৯৭৩ সালে দেশের সংবিধানের আওতায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ মার্চ। এই সংসদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীই যে বিজয়ী হবেন, সেই বিষয়ে সংশয় ছিল না। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ১০ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বর্তায় সংসদের স্পিকার মুহম্মদুল্লাহ্র ওপরে। বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় সংসদে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই কেন পদত্যাগ করলেন, সেই বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা চোখে পড়ে না। কিন্তু এটা বিস্ময়ের বিষয় যে তিনি দায়িত্ব লাভের এত স্বল্প সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করলেন। অথচ তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ গ্রহণ করলেন। মুহম্মদুল্লাহ্ প্রায় এক বছর পর ১৯৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর সংসদের ভোটে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রের চরিত্রের বদল
সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতির অবসান ঘটে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। এই একদলীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনের সূচনা হয়। সংবিধানের এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপরাষ্ট্রপতির পদও সৃষ্টি করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতিকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগের ও অপসারণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। যদিও বলা হয়েছিল যে রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং তাঁর মেয়াদ হবে পাঁচ বছর, কিন্তু সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়, যাতে রাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয় যে ‘(ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে। (খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন, যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত বিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।”
সংবিধানের এই ধারার ফলে সংসদে আলাদা করে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য কোনো নির্বাচন করতে হলো না। অন্যদিকে মুহম্মদুল্লাহ্কে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগও করতে হলো না, কার্যত তাঁর অজ্ঞাতেই তিনি তাঁর পদ হারালেন।
স্বল্পতম সময়ে সংসদে পাস হওয়া এই সংশোধনী কেবল দেশের শাসনব্যবস্থারই বদল ঘটিয়েছিল তা নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রও বদলে দিয়েছিল। অথচ এই নিয়ে সংসদে কোনো রকম আলোচনাই হয়নি, সংসদীয় কোনো কমিটির কাছে এই বিল প্রেরণ করা হয়নি। এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার কথা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকেও আলোচিত হয়নি। দলের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়েছিল ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি। তিন দিনে ৭ ঘণ্টার আলোচনায় দেশে বিরাজমান সংকট নিয়ে আলোচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত দেশের সার্বিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দলের প্রধান এবং সংসদীয় দলের নেতা শেখ মুজিবের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে যে ধরনের শাসনের কথা বলেছিলেন এবং সেই ব্যবস্থায় তাঁর যে ভূমিকা দেখতে পেয়েছিলেন, তিনি সেখানেই ফিরে গেলেন। সংবিধানের সংশোধনের আওতায় নতুন দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ঘোষণা করা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি।
সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করেছিল। সংবিধানের বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। যদিও পরে চতুর্থ সংশোধনীর আওতায় গঠিত একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, ক্ষমতার বিভিন্ন ধরনের পালাবদল ঘটে, কিন্তু রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থাই অব্যাহত থাকে।
এরপর প্রেসিডেন্ট সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে এর আওতায় তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। একই ব্যবস্থায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে তাঁর উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, ১৯৮৬ সালে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ এম এরশাদ নির্বাচিত হন। এসব নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছিল এমন দাবি করা যাবে না।
১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। নতুন সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার প্রক্রিয়া শুরু হলে জানা যায় যে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। সেই সময়ে বিএনপির সদস্য ছিল সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ১৭০ জন। নির্বাচনে বিএনপি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়। তাঁদের প্রার্থীর প্রতি জামায়াতে ইসলামীর ২০ জন সদস্যের সমর্থনের প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগ যোগাযোগ করে। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
নির্বাচনে মোট ৩৩০ জন সদস্যের ২৬৪ জন ভোট দেন। আবদুর রহমান বিশ্বাস পান ১৭২ ভোট, যাতে বিএনপির সব সদস্য ছাড়াও দুজন স্বতন্ত্র সদস্য ভোট দিয়েছিলেন। বদরুল হায়দার চৌধুরী পান ৯২ ভোট। এতে আওয়ামী লীগের একজন সদস্য যথাসময়ে উপস্থিত না থাকায় তিনি ছাড়া সব সদস্য ভোট দেন, এর সঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যোগ দেন। জাতীয় পার্টির ৩৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩৪ জন সংসদে উপস্থিত ছিলেন এবং কারাগারে আটক এরশাদকে সংসদে যোগ দিতে না দেওয়ায় তাঁরা ভোটদানে বিরত থাকেন। এ ছাড়া ভোটদানে বিরত থাকেন জামায়াতের ২০ জন, সিপিবির ৫ জন, ন্যাপের ২ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জাসদের শাজাহান সিরাজ, ইসলামিক ঐক্যজোটের ১ জন। গোপন ভোটের বদলে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার বিধান করার প্রতিবাদে এই সদস্যরা ভোটদানে বিরত ছিলেন। বাংলাদেশের সংসদে এযাবৎ যতবার রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন হয়েছে, ১৯৯১ সালই হচ্ছে একমাত্র সময়, যখন নির্বাচনে বিরোধী দল প্রার্থী দিয়েছিল।
দলের বাইরে থেকে রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে মনোনীত করে এবং তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগের এই মনোনয়ন ছিল একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। দলের বাইরে থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করার এই সিদ্ধান্ত সবার প্রশংসা অর্জন করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েনের বিভিন্ন রকমের লক্ষণ দেখা যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনেন।
সম্ভবত এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই বিএনপি তার দলের বাইরে থেকে কাউকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাতে আগ্রহী হয়নি। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে বদরুদ্দোজা চৌধুরী নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলীয় অবস্থানের বাইরে তাঁর কিছু কাজের কারণে ২০০২ সালের ১৯-২০ জুন দলের সংসদীয় দলের বৈঠকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন অনেক সংসদ সদস্য। সভা শেষে চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘১৯ এবং ২০শে জুন দলের সভায় বিস্তারিত আলোচনার পরে এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিএনপি সংসদীয় দল মাননীয় প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর উপরে আস্থা হারিয়েছে বিধায় তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ এই প্রস্তাবে দলের বৈঠকে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সম্মতি ছিল।
এ–ও বলা হয় যে বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগে রাজি না হলে তাঁকে সংসদে অভিশংসন বা ইমপিচ করে পদচ্যুতির উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই অবস্থায় নিরুপায় বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী ২০০২ সালের ২১ জুন পদত্যাগ করেন। প্রায় তিন মাস সংসদের স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার পর, সংসদে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ। তিনি দ্বিধাহীনভাবেই দলের অবস্থান থেকেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন, ২০০৬ সালে দেশের রাজনৈতিক সংকটকালেও এর থেকে পিছিয়ে আসেননি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই হোক কিংবা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায়ই হোক, এর পর থেকে রাষ্ট্রপতি পদের দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁরাই, যাঁদের দলের প্রতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য প্রশ্নাতীত। ২০০৯ সালে নির্বাচিত মো. জিল্লুর রহমান, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচিত মো. আবদুল হামিদের পরিচয়, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
ক্ষমতার প্রশ্ন
দেশে ১৯৭২-৭৫ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু থাকার সময় এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনরায় চালুর পর এক মেয়াদের ব্যতিক্রম বাদ দিলে সংসদে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিরা দলের বাইরে গিয়ে কোনো ভূমিকা পালন করেননি। দলের প্রতি, বিশেষ করে দলের নেত্রীর প্রতি আনুগত্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার একটি প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে সংবিধানের ৭০ ধারা, যা সংসদে সার্বক্ষণিকভাবে সদস্যদের দলের কঠোর নিয়ন্ত্রণের নিগড়ে আবদ্ধ করে ফেলেছে; সেটি নিশ্চিত করেছে যেন সব সদস্য তাঁদের নিজ দল এবং নেতার কাছেই জিম্মি থাকেন। বাংলাদেশের সংবিধানের যে প্রাথমিক রূপ ১৯৭২ সালে গণপরিষদে গৃহীত হয়, তাতেই প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে অসীম ক্ষমতা। এই বিষয়ে গণপরিষদের আলোচনায় প্রশ্নও উঠেছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর আলোচনায় ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে যেভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানে তেমনভাবেই প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি এই ইঙ্গিতও দেন যে এই ক্ষমতা একনায়কত্বে রূপান্তরিত হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর হাতে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে’ (আসিফ নজরুল, সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২-গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা, ঢাকা: প্রথমা, ২০২২, পৃ. ১১০-১১৫)। প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এতে নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার ওপরেই নয়, এমনকি বিচার বিভাগের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একাদিক্রমে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হস্তান্তর হয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার ভারসাম্যের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে ১৯৯১ সাল থেকে সংসদীয় ব্যবস্থার অধীনে যাঁরা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, রাজনীতিতে, শাসনব্যবস্থায় তাঁদের ভূমিকা রাখার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া আর সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর ‘পরামর্শে’। ফলে প্রধানমন্ত্রী না চাইলে রাষ্ট্রপতি কোনো প্রস্তাবের বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখেন না। তিনি বাস্তবে কিছুই করতে পারেন না। দেশের বিভিন্ন সংকটকালে রাষ্ট্রপতিদের আমরা দেখেছি সংলাপের আয়োজন করতে, কিন্তু তাতে সংকট সমাধানের পথে সামান্যও অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানের এসব বিধিবিধান রাষ্ট্রপতিকে কেবল দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেনি, তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক একনায়কত্বের পথ (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, আলী রীয়াজ, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির সংকট, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ১৯৯৩)। এর সঙ্গে ২০১১ সালের পর পঞ্চদশ সংশোধনী এমন এক শাসনের ব্যবস্থা করেছে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির জায়গা অপসৃত হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এখন ব্যক্তির ইচ্ছে-নির্ভর মাত্র; এই কাঠামোগত বা সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিয়ে কোনো রকমের আলোচনাই নেই, যা আলোচনা তা হচ্ছে ঔৎসুক্যবশত—কে হবেন রাষ্ট্রপতি।
● আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট