দেশের মাদ্রাসা এবং এতিমখানাগুলো ব্যক্তির দান ও সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়ের একটা বড় উৎস কোরবানির পশুর চামড়া। তাই ঈদুল আজহার সময় মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো চামড়া সংগ্রহের দিকে বিশেষ জোর দেয়। তবে এবারে চামড়ার দর নিয়ে কারসাজিতে বিপাকে পড়েছে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকেন্দ্র এতিমখানা ও কওমি মাদ্রাসাগুলো। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সংগৃহীত চামড়া ফেলে দিয়েছে। অনেকে নামমাত্র মূল্যে তা বিক্রি করেছেন। অনেক মাদ্রাসা আবার কম মূল্যে নগদ অর্থে কাঁচা চামড়া ক্রয় করে তা বিক্রি করতে না পারায় পুরোটাই লোকসান হয়েছে। ফলে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোতে এবার নিদারুণ আর্থিক সংকট হতে পারে বলে মনে করছে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এক সময় ঈদে সংগৃহীত কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করেই এসব মাদ্রাসার গরিব ও এতিম শিশুদের বছরব্যাপী খাওয়া, পড়াশোনাসহ সব ধরনের ব্যয় মেটানো হতো। এবারের দাম বিপর্যয়ে সংকটে পড়েছে দেশের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো। তারা শিক্ষার্থীদের বছরব্যাপী ভরণপোষণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
জানতে চাইলে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক ও পরিচালক দাবি করেন, দেশের চামড়া শিল্প দাঁড়িয়েছে তাদের কারণেই। সত্তরের দশকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহের মতো জনবল চামড়া ব্যবসায়ীদের ছিল না। এই কাজটি করতেন মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। লালবাগ ও মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসাগুলোর প্রচেষ্টায় পোস্তগোলায় ট্যানারি শিল্প গড়ে ওঠে। এখন সেই চামড়া ব্যবসায়ীদের কারণেই মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো ন্যায্য আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বলছেন, উপযুক্ত মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে না পারলে আগামী ঈদুল আজহার সময় তারা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করবেন না।
দেশের অন্যতম বড় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গোপালগঞ্জের গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস বিভাগের শিক্ষক মুফতি মুহাম্মদ তাসনীম বলেন, তাদের মাদ্রাসাটি গ্রামে হলেও বছর দশেক আগেও কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রি করে ১০ কোটি টাকা আয় হতো। এই টাকা জমা হয় মাদ্রাসার গোড়াবা ফান্ডে। তা থেকে মাদ্রাসার গরিব এতিম শিক্ষার্থীদের সারা বছরের খাওয়া, শিক্ষা, জীবনযাপনের সব ধরনের ব্যয় বহন করা হয়। চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের কারণে এই গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি জানান, চামড়ার দাম কমায় দিন দিন গোড়াবা ফান্ডের আয় কমছে। এখন ১০ লাখ টাকাও আসে না। এবার তো একেবারেই ধরা। এমনকি অল্প দামে হলেও নগদ অর্থে তারা যে চামড়া কিনেছেন, সেই অর্থ পুরোটাই লোকসান। মুফতি মুহাম্মদ তাসনীম আরও বলেন, লোকজনের কাছে দান ও সহযোগিতা নিয়ে এবার হয়তো গোড়াবা ফান্ডের ঘাটতি মেটানো যাবে। তবে এভাবে কতদিন চলবে?
মোহাম্মদপুরের জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য আতাউল্লাহ আমিন বলেন, ঢাকার বড় মাদ্রাসাগুলো বছর কয়েক আগেও কোরবানির সময় চামড়া বেচে কয়েক কোটি টাকা পেত। যা দিয়ে গরিব শিক্ষার্থীদের সারা বছরের সার্বিক খরচ জোগাড় হতো। চামড়া নিয়ে কারসাজির কারণে এই গরিব শিক্ষার্থীরাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
সিলেট ব্যুরো :সিলেটে সংগৃহীত কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পেয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তা রাস্তা ও নদীতে ফেলেছেন। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া ২০ ট্রাক কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তা ময়লার ভাগাড়ে মাটিচাপা দিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা। অন্তত ১০ টন কাঁচা চামড়া নগরীর উপকণ্ঠ পারাইরচকের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পুঁতে ফেলা হয় বলে জানিয়েছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়র আরিফ নিজে নগরীর বেশ কয়েকটি মাদ্রাসার সংগৃহীত পশুর চামড়া বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কাজ হয়নি।
নগরীর আম্বরখানার খাসদবীর দারুস সালাম মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ঈদের দিন রাতে ৮ শতাধিক গরু ও অসংখ্য ছাগলের চামড়া রাস্তায় ফেলে দেয়। এ প্রসঙ্গে মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি ওলিউর রহমান বলেন, সারাদিন কষ্ট করে চামড়া সংগ্রহ করে চামড়া ব্যবসায়ী বাদশা মিয়াসহ অনেককে ফোন দিয়েও তা বিক্রি করা যায়নি। পরে সেগুলো রাতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি জানান, গত বছর তারা ৮০৬টি গরুর চামড়া প্রতিটি ৫৭১ টাকা করে বিক্রি করেছিলেন। ২৩০টি খাসির চামড়া ২৫ টাকা করে বিক্রি হয়েছিল। এই অর্থ মাদ্রাসার দুস্থ ও গরিব শিশুদের লেখাপড়ায় ব্যয় হয়েছিল। এবারে চামড়া বিক্রির কোনো টাকা না পাওয়ায় এতিম শিশুদের লেখাপড়ায় সমস্যা হবে।
নগরীর অন্যতম মহিলা মাদ্রাসা বারুতখানার মাদ্রাসাতুল বানাতের মুহতামিম মাওলানা আব্দুস সালাম গহরপুরী বলেন, তারা ১৯৯টি গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। সারাদিন চেষ্টার পর ১৪০ টাকা দরে চামড়াগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানান, গত বছর গরুর প্রতিটি চামড়া সাড়ে ৫শ’ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছিল। এবারে সামান্য যে টাকা পেয়েছেন, তাতে সারা বছর কীভাবে চলবে- তাই নিয়ে ভাবছেন তারা।
চট্টগ্রাম ব্যুরো :চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুই বড় কওমি মাদ্রাসার মধ্যে একটি পটিয়া সদরে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা। অন্যটি জিরি আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসা। আল জামিয়া আল ইসলামিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার সহকারী মহাপরিচালক আবু তাহের নদভী জানিয়েছেন, গত বছর গরুর চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল ১ হাজার। এবার তারা চামড়া সংগ্রহ করেননি। তারপরও মাদ্রাসার শুভাকাঙ্ক্ষীরা ৫০টি চামড়া দিয়ে গেছেন। অন্যান্য বছর চামড়া বিক্রি হতো বেশ ভালো দামে। এবার বিক্রি হয়েছে প্রতিটি ১০০ টাকা করে। তাদের মাদ্রাসায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এক হাজার এতিম। এই এতিম শিক্ষার্থীদের খরচ চলে চামড়া বিক্রির অর্থে।
পটিয়া জিরি আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা খোবাইব জানিয়েছেন, গত বছর গরুর চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল এক হাজার ১০০টি, এবার হয়েছে ৫০০টি। অন্যান্য বছর চামড়া বিক্রি করে তিন থেকে চার লাখ টাকা আসত। এবার বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা করে। তিনি জানান, মাদ্রাসার দুই হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬শ’ এতিম ও মিসকিন শিক্ষার্থী রয়েছে।
কর্ণফুলী উপজেলার বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কোরবানি পশুর ৯০০ চামড়া বিক্রি করতে না পেরে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। কারণ এ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে খরচ হতো।
হাটহাজারী উপজেলাধীন হাটহাজারী মাদ্রাসায় পাঁচ হাজার, চারিয়া মাদ্রাসায় ৬০০, বাথুয়া মাদ্রাসায় ৯০০, ইছাপুর মাদ্রাসায় ৫৪০, গড়দুয়ারা মাদ্রাসায় ৪০০, মাদার্শা মাদ্রাসায় ৫০০, ফতেপুর মাদ্রাসায় ৭০০, বড় দীঘিরপাড় মাদ্রাসায় ৪০০টি চামড়া সংগৃহীত হয়েছে। অধিকাংশ চামড়া গড়ে ২৫০ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। মূল্য কম হওয়ায় হাটহাজারী ও চারিয়া মাদ্রাসা সংগৃহীত চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। পরে উপযুক্ত মূল্যে তারা এসব চামড়া বিক্রি করবে।
হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ও আবাসিক ছাত্রদের পরিচালক মুফতি জসিম উদ্দিন জানান, তাদের মাদ্রাসায় বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার এতিম শিক্ষার্থী রয়েছে। কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অনুদান দিয়ে এসব শিক্ষার্থীর খোরাকি হয়। তবে কয়েক বছর ধরে চামড়ার মূল্য কমে আসায় ছাত্রদের খোরাকির ওপর কিছুটা প্রভাব পড়ছে।
ইছাপুর মাদ্রাসার নির্বাহী পরিচালক জাহেদুল্লাহ বিন ইউনুছ বলেন, এক সময় মাদ্রাসার জন্য দান করা গরুর চামড়া বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যেত তা দিয়ে এতিম ছাত্রদের প্রায় ছয় মাসের খরচ চলত। কিন্তু বর্তমান বাজার মূল্যে চামড়া বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গেছে তা দিয়ে দুই/তিন মাসের বেশি খরচ চালানো সম্ভব নয়।