শিশু আইনে হাইকোর্টের নতুন নির্দেশনা

ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সাত দফা নির্দেশনা হাইকোর্টের

0
336
সুপ্রিম কোর্ট

শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন এবং উচ্চ আদালতে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ লক্ষ্যে শিশু আইন ২০১৩ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত শিশুর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের রায়ে সাত দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১ আগস্ট সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে এই রায় দেন। সম্প্রতি ওই রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রকাশ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসঙ্গতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৯৭-এর বিধানমূলে প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসঙ্গতি দূর করতে পারে।

জানা গেছে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর লালবাগ থানার দেলোওয়ার হোসেন খেলার মাঠে দুপুর আড়াইটায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে শিশুদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় ওসমান নামে এক শিশু গুরুতর আহত হলে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন  অবস্থায় সন্ধ্যায় সে মারা যায়।

এ ঘটনায় এক শিশুকে (পুলিশের নথি অনুযায়ী তার বয়স ১৯ বছর) আটক করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনাল শিশুকে রিমান্ডে দেন এবং পরে টঙ্গীর জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান। ওই মামলায় এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে কয়েকজন হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করে।

মামলার নথিপত্র ও বিচারিক কার্যক্রম পর্যালোচনার পর হাইকোর্টে শিশু আইন ২০১৩-এর সাতটি অসঙ্গতি চিহ্নিত করে। এসব অসঙ্গতির বিষয়ে হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেন, অনেকগুলো প্রশ্ন এ মামলার মধ্য দিয়ে সামনে এসেছে। যার মধ্যে শিশুর রিমান্ড কোন আদালত নিষ্পত্তি করবে;

তদন্তের স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ প্রদানের ক্ষমতা কতটুকু;

অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে শিশুকে কি অন্যান্য মামলার আসামিদের মতো ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হবে;

বিচার-পূববর্তী কোন অবস্থায় শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হবে এবং শিশুর বয়স ও জামিনসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে যদি শিশু আদালত ক্ষমতাবান হন, তাহলে কি শুধু অপরাধ আমলে নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে এই মামলার রায়ে হাইকোর্ট শিশুর ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সাত দফা নির্দেশনা তুলে ধরেন। রায়ে বলা হয়, শিশু আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আদালতকে শিশুর বিচারের এই সাত দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।

এই সাত দফা নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রায়ের অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকেও পাঠাতে বলা হয়েছে।

সাত দফা নির্দেশনা : এক. সংশ্নিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কেবলমাত্র মামলার তদন্ত কার্যক্রম তদারকি করবেন এবং এ-সংক্রান্ত বিষয়ে নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ এবং নির্দেশনা প্রদান করবেন।

দুই. রিমান্ড-সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম এবং সাক্ষী) বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্নিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।

তিন. তদন্ত চলাকালীন শিশুকে মামলার ধার্য তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা হতে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।

চার. তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর রিমান্ড, জামিন, বয়স নির্ধারণসহ অন্তর্বর্তী যে কোনো বিষয় শিশু আদালত নিষ্পত্তি করবে এবং এ-সংক্রান্ত যে কোনো দরখাস্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল হলে সংশ্নিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট নথিসহ ওই দরখাস্ত সংশ্নিষ্ট শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন। সংশ্নিষ্ট শিশু আদালতই ওই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করবেন।

পাঁচ. অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ প্রদান করবে। এ ক্ষেত্রে বিচারক শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে কার্য পরিচালনা এবং শিশু আদালতের নাম ও সিল ব্যবহার করবেন।

ছয়. আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো এই যে, আইন মন্দ বা কঠোর হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়। ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ দেবেন এবং পরবর্তী সময়ে নথি বিচারের জন্য শিশু আদালতে পাঠাবেন।

সাত. শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে বিশেষ আইনসমূহের অধীনে জিআর মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের জন্য পৃথক পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার বিধান থাকায় সংশ্নিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অপরাধ আমলে নেবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.