দিন যায়, মাস যায়; তবু মুক্তির কোনো ‘বার্তা’ নেই কারাবন্দি বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের। কনিষ্ঠ অনেকের ধীরগতিতে জামিনে মুক্তি মিললেও কেন্দ্রীয় নেতাদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। মামলা জটিলতায় আটকে আছেন তারা। দলীয় আইনজীবীরা দৌড়ঝাঁপ করলেও জামিনে মুক্তি মিলছে না। এতে দীর্ঘ হচ্ছে কারাবাসের সময়। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তীব্র শীতে প্রবীণ নেতারা আরও কাবু হয়ে পড়ছেন বলে
জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ঠিকমতো ওষুধ না খাওয়া ও সেবাযত্ন না পাওয়ায় বাড়ছে বয়স্ক এসব নেতার রোগব্যাধি ও শারীরিক নানা জটিলতা। এর পরও আত্মবিশ্বাসী নেতারা মনোবল ধরে রেখেছেন। কারাবন্দি অন্য নেতাকর্মীর সাহস জোগাচ্ছেন। এসব জ্যেষ্ঠ নেতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে এমনটা জানিয়েছেন তারা।
কারাবন্দি জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাধিক পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। ওই সব পরিবারের সদস্যরা জানান, কারাগারে নেতারা মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক, ইতিহাস, অর্থনীতির বই ও পত্রিকা পড়েন এবং কারাবন্দি নেতাকর্মীর খোঁজখবর নিয়ে সময় কাটান। কেউ কেউ কারাগারের জীবন নিয়ে লেখালেখি করার চেষ্টা করছেন। দেশের রাজনীতির খোঁজ নেন সাক্ষাতে যাওয়া সবার কাছ থেকেই।
কথা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সহধর্মিণী রাহাত আরা বেগমের সঙ্গে। তিনি নিজেও অসুস্থ। গ্রেপ্তারের দেড় মাস আগে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরেন তারা। রাহাত আরা জানান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উচ্চ রক্তচাপ, আইবিএস, মেরুদণ্ড, দাঁতের সমস্যাসহ আরও বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পড়ে গিয়ে পাঁজরে গুরুতর আঘাত পাওয়ার যন্ত্রণা। সিঙ্গাপুরে সেই চিকিৎসা করিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে থেরাপি দিতে হতো। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় এ ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। কয়েক মাস ঠিকমতো চলতে পারেননি। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হতো তাঁকে।
অসুস্থ এই নেতাকে ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর নেওয়া হয় কারাগারে; তিনি ১১টি মামলার আসামি। গত শুক্রবার কেরানীগঞ্জ কারাগারেই তাঁর ৭৮তম জন্মদিন পার করতে হয়েছে একাকিত্বে। বয়স ও অসুস্থতার মধ্যে তীব্র শীতে শারীরিক জটিলতা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। ১০ মামলায় জামিন হলেও বাকি রয়েছে একটিতে। কবে হবে, কেউ বলতে পারেননি।
মির্জা ফখরুলকে গত ১৫ বছরে আটবার কারাগারে যেতে হয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে এ সময়ের মধ্যে। পুলিশি রিমান্ডে যেতে হয়েছে সাতবার। পরিবারের সদস্যরা জানান, আপসকামিতার জন্য অনেক চাপ সইতে হয়েছে আপাদমস্তক এই রাজনীতিককে। কিন্তু মাথা নোয়াবার নেতা নন তিনি। কারাগারে দেশি-বিদেশি বই পড়ে আর নেতাকর্মীর সঙ্গ দিয়েই তাঁর সময় কাটছে। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১১১ মামলার মধ্যে ২৫টি মামলার বিচারকার্জ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তাঁর স্ত্রী আরও জানান, মির্জা ফখরুলের শরীরটা ভালো না। ওজন কমে গেছে পাঁচ কেজি। প্রতিবার জন্মদিনে মেয়েরা তাদের বাবাকে প্রথম প্রহরেই শুভেচ্ছা জানায়। এবার তো সেটা হয়নি। কারাগারে গিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসতে হয়েছে। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও অটুট রয়েছে মনোবল। নতুন দিনের আশায় তিনি এখনও আত্মবিশ্বাসী।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ১৮৪ মামলায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ সময়ে ২৭ হাজার ৫১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি।
গত ৩১ অক্টোবর রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন এ নেতার বিরুদ্ধেও রয়েছে অনেক মামলা। এর আগে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই নেতাও অনেক দিন ধরে অসুস্থ। গত সেপ্টেম্বরে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান তিনি।
‘পরিচ্ছন্ন’ আরেকজন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তাঁর বয়সও ৭৬ পার হয়েছে। বয়সের ভারে এই শীতে কাবু হয়ে পড়ছেন তিনি। রয়েছে বিভিন্ন রোগ। কারাগারে তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতির দেশ-বিদেশের বই পড়েই বেশির ভাগ সময় কাটান বলে জানান তাঁর ছেলে ইসরাফিল খসরু। তিনি জানান, কারাগারে এত বেশি দিন আটক থাকার ঘটনা এবারই তাঁর প্রথম। শীতে অ্যাজমা নিয়ে তাদের পরিবার চিন্তিত হলেও তাঁর বাবার মনোবল এখনও অটুট রয়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১০ মামলার মধ্যে ৯টিতে জামিন হলেও একটিতে এখনও মেলেনি বলে জানান ইসরাফিল।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বেশ অসুস্থ। তাঁর স্ত্রী নাসিমা সরোয়ার জানান, বয়সের কারণে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। তার ওপর ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। এখন তাঁর মুক্তির অপেক্ষায় আছে পরিবার।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বেশির ভাগ সময় কাটে বই পড়ে আর কারাবন্দি নেতাকর্মীর খোঁজ নিয়ে। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা নাসিমা ফেরদৌসি জানান, কিডনির সমস্যা আর মেরুদণ্ডের আঘাতে বেশ কষ্টে থাকলেও মনোবল অটুট রয়েছে সেই আগের মতো।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন হৃদরোগী। তাঁর সময় কাটে বই পড়ে। তিনি ভূরাজনীতির বইয়ের প্রতিই বেশি আগ্রহী বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
এসব নেতা ছাড়াও কারাগারে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমিনুল হক, দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনুসহ আরও অনেকে। এক বছর ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন শেখ রবিউল আলম রবি, সাইফুল আলম নিরব, মোনায়েম মুন্না, এস এম জাহাঙ্গীর, গোলাম মাওলা শাহীনসহ অনেকে।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্যমতে, কারাগারে আটক এসব নেতাও ভালো নেই। কবে তাদের মুক্তি মিলবে, কবে আবার প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হবেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কেন্দ্রীয় ওই সব নেতার বেশির ভাগের শারীরিক জটিলতা ও অসুখের পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে মহানগর উত্তরের আমিনুল হকের কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে এবং দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনুর অপারেশনে ইনফেকশন সৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েক মাস ধরে। এসব নেতার পরিবার কঠিন সময় পার করছে। দিনরাত আদালত চত্বর আর আইনজীবীর চেম্বারে দৌড়াতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানদের লেখাপড়ায়ও।
গত ১৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন মিরপুরের সাবেক কমিশনার শামীম পারভেজ। ১৩৪টি মামলার মধ্যে একটি মামলায় তাঁর আড়াই বছরের সাজা হয়েছে। তাঁর সহধর্মিণী জান্নাত আরা ফেরদাউস জানান, আর কত নির্যাতন সইতে হবে, তা তাদের জানা নেই। ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ১৫ মাসের শিশু সন্তানসহ তাঁকেও কারাগারে যেতে হয়েছিল। ওই সময় তাদের বাসায় ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। তাদের সেই শিশু এখন বড় হয়েছে। আদালত চত্বরে যখন বাবার হাতে হ্যান্ডকাফ, পায়ে ডান্ডাবেড়ি দেখে, তখন তাদের একমাত্র কন্যা জাইমা নুসাবাহ সহ্য করতে পারে না। বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। রাজধানীর স্কলাস্টিকার ষষ্ঠ শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাটাও তার দেওয়া হয়নি বাবা কারাগারে বলে।
কারাবন্দি বিএনপি নেতাদের স্বজনের অভিযোগ, কারাগারে সাধারণ কয়েদির স্বজন সপ্তাহে দেখা করতে পারলেও বিএনপি নেতাকর্মীর জন্য সেটা দুই সপ্তাহে একবার। তবে সেটাও অনেক সময় হয় না। অনেক নেতাকর্মীর স্বজনকে মাসে একবার দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়।