শপথ করা কুমারী’ নারীদের একাকিত্বের জীবন

0
199
আলবেনিয়ার নারী জিস্টিনা গ্রিশাজ

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের দেশ আলবেনিয়ার নাগরিক জিস্টিনা গ্রিশাজ। বয়স ৫৮ ছুঁয়েছে। এ বয়সেও দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত একটি উপত্যকায় বিশাল এক বাড়িতে একাকী থাকেন তিনি। কাঠ কেটে, ট্রাক্টর চালিয়ে, গবাদিপশুর দেখভাল করে তাঁর সময় কাটে। কিন্তু এখন তাঁকে একাকিত্ব পেয়ে বসেছে।

যদিও এই একাকিত্বের জীবন জিস্টিনার নিজেরই বেছে নেওয়া। বিয়ে করেননি তিনি। পরিবার তথা বাবা-মা-ভাইবোনের জন্য নিজের জীবনকে ‘উৎসর্গ’ করেছেন। থেকে গেছেন ‘কুমারী’।

একসময় আলবেনীয় সমাজে এ ধারা বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেশের অনেক নারী জীবনে কখনোই বিয়ে না করার ঘোষণা দিতেন। সমাজে তাঁদের ভাবমূর্তি ছিল বেশ উঁচুতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধ্যানধারণা বদলে গেছে। তবে এখনো দেশে অল্প কজন ‘শপথ নেওয়া কুমারী’ টিকে রয়েছেন। এমনই একজন হচ্ছেন জিস্টিনা গ্রিশাজ।

পিতৃতান্ত্রিক আলবেনীয় সমাজে যদি কোনো নারী বিয়ে না করে পরিবারের হাল ধরতে চাইতেন, স্বাধীনভাবে উপার্জন করতে চাইতেন, তাহলে ওই নারীকে কিছু অধিকার ছাড়তে হতো। এর মধ্যে রয়েছে যৌনতা পরিহার, কখনোই বিয়ে না করা, সন্তান না নেওয়া প্রভৃতি। এসব নারী বুরেনেশে বা শপথ নেওয়া কুমারী নামে পরিচিত।
কাঠ কেটে, ট্রাক্টর চালিয়ে, গবাদিপশুর দেখভাল করে সময় কাটে জিস্টিনা গ্রিশাজের

জিস্টিনা এ পথে হেঁটেছিলেন ৩০ বছর আগে। পরিস্থিতি তাঁকে ‘শপথ নেওয়া কুমারী’ হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। ওই সময় জিস্টিনার বাবা ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। বড় ভাই মারা গেছেন। এ সময় ঘরে থাকা অসুস্থ বাবা, মা আর ছোট ভাইবোনদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন জিস্টিনা।

কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ায় জীবন সুখকর হয়নি জিস্টিনার। ইতিহাসের বাঁকবদলে অসংখ্য আলবেনীয়র মতো জিস্টিনার আত্মীয়স্বজন দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু তাঁকে থেকে যেতে হয়েছে। বিশাল একটি বাড়িতে এখন তিনি কার্যত একা বসবাস করেন।

জিস্টিনা বলেন, ‘একসময় পরিবারের জন্য আমি আত্মত্যাগের কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলাম। এখন একাকিত্ব আমার চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। পুরো বাড়ি নৈঃশব্দ্যে ভরে গেছে।’

একসময় আলবেনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসন কার্যকর ছিল। পরবর্তীকালে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে অগ্রসর হয় দেশটি। জিস্টিনার বেড়ে ওঠা সমাজতন্ত্রের আমলে। আলবেনিয়ার উত্তরে যে উপত্যকায় তাঁদের বাড়ি, সেখানে তীব্র শীত থাকে। ওই অঞ্চলে মানুষজনের বসবাস তুলনামূলক কম হলেও সবাই নিজেদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্য মেনে চলার ব্যাপারে বেশ সচেতন।

এখন জিস্টিনা বুনো ফুল, পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা শিকড় আর ফলের ব্র্যান্ডি মিশিয়ে ভেষজ ওষুধ তৈরি করেন। পরে সেসব ওষুধ পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে নিজের খরচ চালান। এরপরও ভাইবোন ও তাঁদের ১২ সন্তানদের কাছে সাহায্য চাইতে নারাজ জিস্টিনা। তাঁর মতে, ‘এটা ওদের জন্যও কষ্টকর হবে। কেননা, ওরা সবাই এখন কোনো না কোনো দেশে আলবেনীয় অভিবাসী।’

‘আমি লুকিয়ে থাকতাম’

বিশাল একটি বাড়িতে এখন একা বসবাস করেন জিস্টিনা গ্রিশাজ
বিশাল একটি বাড়িতে এখন একা বসবাস করেন জিস্টিনা গ্রিশাজ

জিস্টিনাদের পরিবারে তখন ছয়জনের অন্ন সংস্থান করতে হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ব্যয়, ওষুধ কেনার খরচ। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই মারা গেছেন। এই কঠিন পরিস্থিতি ভাবিয়ে তোলে জিস্টিনাকে। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিয়ে না করার ঘোষণা দেন।

‘আমি আমার ভাইবোনদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং বাবার ওষুধ কেনায় সহায়তা করতে একজন পুরুষের মতো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম’—বললেন জিস্টিনা। যদিও এ সিদ্ধান্তে তাঁর মা রাজি ছিলেন না। জিস্টিনার বিয়ে দিতে চাইতেন তিনি। কিন্তু জিস্টিনা অনড় ছিলেন। তিনি বলেন, ‘লোকেরা বিয়ের জন্য যখন দেখতে আসত, আমি লুকিয়ে থাকতাম।’

বছরখানেকের মধ্যে পরিবারের ‘মূল ভিত্তি’ হয়ে ওঠেন জিস্টিনা। এ জন্য তাঁকে চুল ছেঁটে ফেলতে হয়। লম্বা প্যান্ট পরতেন জিস্টিনা। পুরুষদের সঙ্গে স্থানীয় ক্যাফেতে বসে ব্র্যান্ডি খেতেন। পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মতামত গ্রহণ করা হতো।

ওই সময় জিস্টিনাদের গ্রামে ২০টির মতো পরিবারের বসবাস ছিল। সবাই তাঁকে ‘দুনি’ নামে ডাকত। এটা জিস্টিনার ডাকনাম। পার্শ্ববর্তী লিপুসি গ্রামের একটি রেস্ট হাউসের মালিক পউলিন নিলাজ বলেন, জিস্টিনার ‘শপথ নেওয়া কুমারী’ হওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই সমর্থন দিয়েছিল।

নিলাজ আরও বলেন, ‘কঠিন এ পথ চলতে জিস্টিনা স্বাভাবিক নারীসুলভ কাজ ও আচরণ ত্যাগ করেছিলেন। আমি জিস্টিনাকে সব সময় এভাবেই দেখেছি। হঠাৎ তিনি যদি বিয়ে করতেন, তাহলে বরং আমি অবাক হতাম।’

এই নারীদের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে

‘শপথ নেওয়া কুমারীরা’ একটি পরিবারের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করেন। তাঁরাই পরিবারের প্রধান রোজগারের ব্যক্তি। এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানী আফেরদিতা অনুজি বলেন, ওই সময় কোনো নারী কুমারী থাকার শপথ নিলে তাঁর সেই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানানো হতো। প্রশংসা করা হতো।

এই নৃবিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘যে নারীরা পরিবারের স্তম্ভ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠিন সব কাজ করতেন, উপার্জন করতেন। সবাই তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন। এমন সিদ্ধান্তকে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।’

যে নারীরা পরিবারের স্তম্ভ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠিন সব কাজ করতেন, উপার্জন করতেন। সবাই তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন।আফেরদিতা অনুজি, নৃবিজ্ঞানী

তবে বলকান রাষ্ট্র আলবেনিয়ায় জিস্টিনার মতো কত নারী ‘চিরদিন কুমারী’ থাকার শপথ নিয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে দেশটির আধুনিকতার পথে যাত্রায় এ সংখ্যা ক্রমেই কমে এসেছে।

এ বিষয়ে জিস্টিনা বলেন, ‘সম্ভবত আমিই শেষ নারী। আমার মাধ্যমে এ অধ্যায় শেষ হতে যাচ্ছে। আমার পর আর কোনো শপথ নেওয়া কুমারী থাকবেন না। কারণ, এখন জীবন অন্য রকম। আগের মতো চাপ নেই। যাঁরা কাজ করতে চান, তাঁরা যেকোনো জায়গায় করতে পারেন।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, আলবেনীয় নারীদের বিয়ে না করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতির পেছনে যৌনতা বড় কোনো ভূমিকা রাখেনি।

এ বিষয়ে আলবেনিয়ার ইতিহাসবিদ, অধিকারকর্মী ও একটি জাদুঘরের কিউরেটর এলসা বাল্লাউরি বলেন, যৌন সম্পর্ক এখানে কোনো বিষয় নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতির ফলাফল এটা।’

চিরদিন কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে যৌনতার ভূমিকা ছিল, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন জিস্টিনা। শুধু বলেছেন, ‘এমনকি ঈশ্বরেরও এমন কথা শোনা উচিত নয়।’

কেমন আছেন জিস্টিনা

জিস্টিনার জীবনটা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এর কারণ, যেই পরিবারের জন্য তিনি নিজের জীবনের বড় একটা সময়, জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে বলি দিয়েছেন, সেই পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য এখন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। শেষ বয়সে একাকী রয়ে গেছেন জিস্টিনা।

উপার্জনের জন্য জীবনের দীর্ঘ সময় মাঠ-ঘাট দাপিয়ে বেড়াতে হয়েছে জিস্টিনাকে। বাইরের কাজে বেশি অভ্যস্ত তিনি। সেই তুলনায় ঘরের কাজে সাবলীল নন তিনি। শেষ বেলায় এসে জিস্টিনাকে জীবনের তাগিদেই রান্না, ঘর পরিষ্কারের মতো গৃহস্থালি কাজ শিখতে হয়েছে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.