ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে এসেছে। এতে করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় এলাকায় লোডশেডিং আরও কয়েক দিন চলবে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে।
গত শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সতর্কতার অংশ হিসেবে মহেশখালীর ভাসমান দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দুটি এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি এবং সামিট গ্রুপ।
এক্সিলারেটের টার্মিনালটি পুনরায় চালু করতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। আর সামিটের টার্মিনাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আগের জায়গাতেই আছে। সংযোগ ফিরিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু করার প্রক্রিয়া শুরু করবে আজ সোমবার। আজ প্রস্তুতি শেষ হলে গ্যাস সরবরাহের সময় ঠিক করা যাবে।
এলএনজি বন্ধে গ্যাসসংকট, দফায় দফায় লোডশেডিং
পেট্রোবাংলার হিসাবে, দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। গত শুক্রবারও এলএনজি থেকে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া গেছে। ওই দিন রাতে এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ হওয়ার পর গতকাল রোববার গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ২১৫ কোটি ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, স্বাভাবিক সময়েও গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি থাকে। এক খাতে বন্ধ করে অন্য খাতে সরবরাহ বাড়ানোর (রেশনিং) মাধ্যমে ঘাটতি সমন্বয় করা হয়। এলএনজি বন্ধের পর ঘাটতি আরও বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২১৭ কোটি ঘনফুট। গতকাল সরবরাহ করা হয়েছে ৮৮ কোটি ঘনফুট। এলএনজি বন্ধের আগে এ খাতে সরবরাহ করা হয়েছে ১১১ কোটি ঘনফুট।
চট্টগ্রামের গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এলএনজি বন্ধের পর গত শনিবার গ্যাস সরবরাহ কিছু ছিল। এখানকার সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বাসার গ্রাহকেরা অল্প গ্যাস পেয়েছেন। তবে গতকাল আর কেউ গ্যাস পাননি।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম গতকাল বলেন, দিনে তাদের চাহিদা ৩০ কোটি ঘনফুট। গতকাল সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ আছে। এলএনজি টার্মিনাল চালু হলে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে।
গ্যাস–সংকটের প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। দুই দিন ধরে গ্যাস না পেয়ে তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে ফোন করছেন বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকেরা। আবার কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস থাকলেও চাপ কমে যাওয়ায় রান্না করতে সমস্যা হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি সচিবালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওটা থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হতে ১২ থেকে ১৫ দিন লাগতে পারে। আরেকটি থেকে শিগগিরই এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে। এতে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে ভালো হবে।
ঢাকায় দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং
গ্যাসের সরবরাহ কমায় চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ফলে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন কমতে থাকে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এখন তা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেছে। এতে লোডশেডিং তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, গতকাল দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে দুপুর ১২টায় ৯ হাজার ৭৭৪ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং হয়েছে ২ হাজার ১২৬ মেগাওয়াট। এর আগে শনিবার রাত ১২টায় লোডশেডিং হয় প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট।
তবে গ্রাহক পর্যায়ে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার তথ্য বলছে, লোডশেডিং হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) শনিবার একাই সর্বোচ্চ লোডশেডিং করেছে ২ হাজার ২৭০ মেগাওয়াট। গতকালও দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে তাদের। গত শনিবার ঢাকাতেও পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে দুই বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)।
গতকাল ঢাকায় দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। ডেসকো বলছে, গতকাল বেলা একটায় তাদের চাহিদা ছিল ১ হাজার ১৩৫ মেগাওয়াট। এ সময় সরবরাহ করা হয়েছে ৯৩০ মেগাওয়াট। ৮২টি ফিডার (নির্দিষ্ট এলাকায় একটি ফিডার থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়) বন্ধ রেখে ২০৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। এর আগে দুপুর ১২টায় বন্ধ রাখা হয় ৯৭টি ফিডার।
ডিপিডিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দাবি করেছেন, শনিবারের চেয়ে গতকাল লোডশেডিং কিছুটা কমেছে। বেলা একটার দিকে তাদের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭৭৪ মেগাওয়াট। সরবরাহ পেয়েছেন ১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট। ৩২৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করে ঘাটতি পূরণ করেছেন।
বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনই বাড়ছে না
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার গতকাল বলেন, গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে না। তাই উৎপাদন বাড়াতে আরও একটু সময় লাগবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হচ্ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি বড় অংশ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। সিদ্ধিরগঞ্জ, হরিপুর, ঘোড়াশালের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এগুলো চালানো যাচ্ছে না। কয়লার অভাবে গত ২৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ আছে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে করে আরও কয়েক দিন লোডশেডিংয়ে ভুগতে হবে গ্রাহকদের।
বর্তমান লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না, জানতে চাইলে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রভাবটা থাকবে, তবে খুব বেশি না। একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি যে তৈরি হয়েছিল, এ সমস্যাটা আর থাকবে না। আগামী দুই দিনের মধ্যে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।