লতিফুর রহমান আমাদের সাহস জুগিয়ে চলেছেন

0
135
লতিফুর রহমান

একবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান ঠিক করেছিল, ‘বাধা আসে, পেরিয়ে যাই’। আমাদের সবারই জীবনে এই কথাটা সত্য। ব্যক্তিজীবনে এবং সমষ্টিগত জীবনে। বাধা আসবেই, পেরিয়েও যেতে হবে। একটা জাতির জীবনেই উত্থান-পতন থাকে। ভালো সময়, খারাপ সময় থাকে। বাধা পেরিয়ে সামনে যেতে হবে। সাহস হারালে চলবে না। গতি কমে আসতে পারে, তাই বলে নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মাথা নত করাও চলবে না।

সাংবাদিকতা পেশাটাই এমন যে, তা জীবনের সমার্থক হয়ে ওঠে, এটা আটটা-পাঁচটা অফিস করা নয়। আমরা যারা সাংবাদিকতাকে জীবিকা করে তুলেছি—তারা খুব ভালো করে জানি, আমাদের চলার পথ ফুলে ঢাকা নয়, বাধা আসবেই। কবে, কোথায়, কোন দেশে সাংবাদিকতা খুব একটা সহজ কাজ ছিল? কোথায় বাধা আসেনি?

ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান (২৮ আগস্ট ১৯৪৫—১ জুলাই ২০২০)
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান (২৮ আগস্ট ১৯৪৫—১ জুলাই ২০২০)

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া স্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানকে আমরা সুসময়ে এবং দুঃসময়ে স্মরণ করি। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের বিজয়ে, এই জাতি বিজয়ী হবেই, এই বিশ্বাস থেকে তিনি কোনো দিনও নড়েননি। বাংলাদেশের জয়ের পথে তরুণদের ভূমিকা থাকবে সবচেয়ে বেশি, এটা তিনি বলতেন। আর একটা দেশের অগ্রগতিতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাতে তাঁর ছিল অটল আস্থা। তিনি বিশ্বাস করতেন সম্পাদকীয় স্বাধীনতায়। উদ্যোক্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো দিনও জিজ্ঞেস করেননি যে কাগজে কী ছাপা হবে, হচ্ছে। কোন খবরটা দেওয়া উচিত, কোনটা নয়—এসব ব্যাপারে একটা কথাও তিনি কোনো দিনও বলেননি। কিন্তু যখন আঘাত আসত, তখন শুধু সাংবাদিকদের ওপরে আসত না, মালিক হিসেবে তাঁর ওপরে আসত বড় ঝড়টা। তিনি অবিচল থাকতেন। এ ব্যাপারে কোনো দিনও একটুখানি ‘উফ’ অব্যয়ধ্বনিও উচ্চারণ করেননি। আর প্রথম আলোর সম্পাদককে ডেকে বলেছেন, আপনার প্রতিষ্ঠান সুসময় পার করেছে, দুঃসময়ও পার করতে হতে পারে। ব্যবসায় লাভও থাকে, ক্ষতিও থাকে। ক্ষতি হলে হবে। আপনি আপস করবেন না।

লতিফুর রহমান: একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীর বিদায়

লতিফুর রহমান ২০১২ সালে পান ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’। ভারতের মুম্বাইয়ে ২০১৭ সালে লতিফুর রহমান লাভ করেন ‘সার্ক আউটস্ট্যান্ডিং লিডার’-এর সম্মাননা। সে অনুষ্ঠানে পেপসিকোর ইন্ডিয়া রিজিয়নের চেয়ারম্যান শিবকুমার লতিফুর রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দয়ালু থেকে কীভাবে এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, লতিফুর রহমান তার নিদর্শন।’

লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মৃত্যু থেকে আহরণ করেছিলেন সাহসিকতার শিক্ষা। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পরপর তিনি আমাদের বলতেন, ছোট্ট ছেলে ফারাজ চরম বিপদের মুখে যে সাহসিকতার পরিচয় দিল, যে মূল্যবোধ দেখাল, আমরা কি বিপদের মুখে তা দেখাতে পারব?

এই প্রশ্নের একটা উত্তর আমার কাছে আছে। মা বই লেখার জন্য আমি বহু মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিই। তাঁদের অনেকেই আমাকে বলেছেন, মানুষ সব সময় সাহসী থাকে না। কিন্তু ঠিক প্রয়োজনের সময়, বিপদের মুখে, সাহসী মানুষেরা সাহসী হয়ে ওঠেন। অন্য সময় দেখা যাবে, এই মানুষটি অনেক ছোটখাটো ব্যাপারে ভয় পাচ্ছেন।

ফারাজ আইয়াজ হোসেন ঠিক সময়ে অনেক বড় সাহস দেখিয়েছিল। লতিফুর রহমান বিপদের মুখে প্রচণ্ড সাহসী থাকতেন। তাঁর অবিচল আদর্শবাদিতা আমাদের সাহস জোগাত। আমাদের অনেক ঝড়বৃষ্টি থেকে ছাতার মতো রক্ষা করত। ১ জুলাই দুই সাহসী মানুষের মৃত্যুদিন, নাতির চলে যাওয়ার চার বছর পর নানাও বিদায় নেন।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি প্রথম আলোয় আসতেন, প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। এই মুহূর্তটা ছিল আমাদের জন্য ভীষণ অনুপ্রেরণার। তিনি দুটো কথা বলতেন। এক. নৈতিকতার প্রশ্নে ছাড় দেবেন না। সততার বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুই. একজন সাংবাদিক নাগরিক হিসেবে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মতবাদ বা আদর্শ নিজের মধ্যে ধারণ করবেন, কিন্তু যখন তিনি লিখবেন, তখন তাঁকে হতে হবে দলনিরপেক্ষ। নিরপেক্ষতায় কখনো ছাড় দেওয়া যাবে না। প্রথম আলো ছিল তাঁর প্রিয় একটা প্রতিষ্ঠান। প্রথম আলোর সাফল্য তিনি খুবই প্রীতির সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতেন। আর তিনি আমাদের বলতেন বড় স্বপ্ন দেখতে। প্রথম আলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১০০ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকবে, এই ছিল তাঁর আশা। তিনি বলতেন, একটা পত্রিকা রোজ ভোটে দাঁড়ায়। মানুষ পকেটের টাকা খরচ করে একটা পত্রিকা কেনে। তার আস্থা না থাকলে সে আর এই কাগজ কিনবে না। আরেকটা কিনবে। কাজেই একটা পত্রিকাকে রোজ পাঠকের ভোটে জয় লাভ করতে হয়!

আমরা, প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া এই সাহস এবং নৈতিকতার শিক্ষার কথা সব সময় স্মরণ করি। বিপদের মুখে এই উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদেরও সাহসী রাখে। কর্মক্ষেত্রে নীতির প্রশ্নে আপসহীন রাখে। আমরা বিনয়ী থাকি, কিন্তু আমাদের মাথা থাকে উঁচু।

পয়লা জুলাই, লতিফুর রহমান সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁর জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো নিজেদের চলার পথের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করব, আবারও, বারবার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.