লিভারপুলের ১৫ বছরের যন্ত্রণার মর্ম বুঝতে পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার সেই লাইন অন্য অর্থে আবিষ্কার করতে হয়—
‘প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে।’
১০ মার্চ, ২০০৯। সাদা মেঘের ভেলা ছাপিয়ে অ্যানফিল্ডে গোধূলিবেলায় সেদিনও সূর্যটা লাল টকটকে দেখা গিয়েছিল, লিভারপুলের জার্সির মতোই। স্টিভেন জেরার্ড-ফার্নান্দো তোরেসরা গোল করে সেই সূর্যকে যেন আরও রক্তিম বানিয়ে ছাড়েন। রিয়াল মাদ্রিদের ১১ ‘সাদা মেঘের ভেলা’ সেদিন ৪-০ গোলের হারে স্রেফ উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর মাদ্রিদের মেঘের ভেলার মুখোমুখি হয়ে লাল টকটকে সূর্যটা যে প্রতিবারই রং হারাবে, ডুবে যাবে, তা জানত কে!
এই ১৫ বছরে টানা ৮ ম্যাচ জয়হীন। এর মধ্যে ৭টিতেই হার! লিভারপুলের সমর্থকেরা এই ১৫ বছরে গোটা পৃথিবীটাই পাল্টে যেতে দেখেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের শিরোপাসংখ্যা ৯ থেকে হলো ১৫টি, লেস্টার সিটির মতো ক্লাবও জিতে নিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, এমনকি ৩৬ বছর অপেক্ষার পর আর্জেন্টিনাও জিতেছে বিশ্বকাপ, লিভারপুল নিজেরাও প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে ৩০ বছর পর। তবু লিভারপুল সমর্থকদের আরেকটি প্রতীক্ষা শেষ হচ্ছিল না। সেই ৮ ম্যাচে প্রতিবারই আশার সূর্য উদিত হয়ে ভেতরে-ভেতরে রক্তক্ষরণে ডুবেছে। কিন্তু কথায় আছে, ‘সূর্য ডোবার সময় কিছুক্ষণের জন্য আকাশে ভোরের মতো রং দেখা যায়, যেন মানুষ আশা করে কাল আবার সকাল হবে।’ লিভারপুল সমর্থকেরা এই ১৫ বছর ধরে তেমনই এক সকালের প্রতীক্ষায় ছিলেন। যে সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হবে, বুকের ভেতরকার ‘সাদা’ পাথরটা নেমে গেছে!
আজ সেই সকাল। দেড় দশক প্রতীক্ষার পর গতকাল রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালকে ২-০ গোলে হারিয়েছে লিভারপুল। সেই অ্যানফিল্ডে, সেই ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ গানের ছন্দে। তাই বুঝি লিভারপুল কোচ আর্নে স্লট ম্যাচ শেষে গায়ে অদৃশ্য ভদ্রতার লেবাসটা আর রাখেননি। একঝটকায় খুলে তিনি যা বলেছেন, সেটির বাংলা অর্থ আসলে প্রকাশযোগ্য নয়। তবে ইংরেজিতে কিছুটা সহনীয়। এই দেড় দশকজুড়ে রিয়াল মাদ্রিদ লিভারপুলের কাছে কেমন ছিল, সেটা বুঝিয়েছেন একটি বাক্যে—‘পেইন ইন দ্য অ্যাস।’
কাছাকাছি বাংলা অর্থে সে কথার অর্থ হতে পারে, অবশেষে সেই ‘সাদা’ ‘কাঁটা’টি সমূলে উৎপাটন করতে পারল লিভারপুল। অবশেষে!
খুব প্রতীক্ষিত কোনো কিছু ধরা দিলে তার স্বাদটা যেমন আলাদা হয়, তেমনি নাটকীয়তাও নাকি কম হয় না! অ্যানফিল্ডের রঙ্গমঞ্চেও গতকাল রাতে তেমন নাটকই হলো ম্যাচের শেষ অর্ধে। গোল হলো দুটি, পেনাল্টি মিসও হলো দুটি। আর পেনাল্টি দুটি মিস করলেন কারা? দুই দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকা—কিলিয়ান এমবাপ্পে ও মোহাম্মদ সালাহ!
৫২ মিনিটে রিয়ালের বক্সের ভেতর থেকে অ্যালেক্সিস ম্যাক-অ্যালিস্টারের গোলে লিভারপুল এগিয়ে যাওয়ার পর গর্জে উঠেছিল অ্যানফিল্ডের টইটম্বুর গ্যালারি। ৬০ হাজার দর্শকের সামনে ৯ মিনিট পরই পেনাল্টি মিস করে বসেন রিয়াল তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। লিভারপুলের নিয়মিত গোলকিপার আলিসন চোটে পড়ায় পোস্টে দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়া আইরিশ গোলকিপার কেলভিন কেলাহার বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে এমবাপ্পের শট ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে অ্যানফিল্ডের গ্যালারি। এই দুই সপ্তাহে তিনটি পেনাল্টি সেভ করলেন কেলাহার, তাতে গড়েছেন ইতিহাসও। গত ১১৫ বছরের মধ্যে লিভারপুলের ইতিহাসে প্রথম গোলকিপার হিসেবে ঠেকালেন টানা দু্ই ম্যাচে পেনাল্টি। চ্যাম্পিয়নস লিগে এই মৌসুমে তিন ম্যাচে কোনো গোল হজম করেননি, শট ঠেকিয়েছেন ১৩টি। অথচ চোট থেকে আলিসন ফিরলেই তাঁকে বসতে হবে বেঞ্চে। লিভারপুলের সাবেক কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের দেওয়া তকমা ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা গোলকিপার’ এর ভাগ্য কী নির্মম!
যেমনটা এমবাপ্পেরও। যেমনটা সালাহরও। ফরাসি তারকার ৬১ মিনিটে পেনাল্টি মিসের ৯ মিনিট পরই একই পরীক্ষা দিতে হয়েছে সালাহকে। ৭০ মিনিটে লিভারপুলের পাওয়া পেনাল্টি বাঁ পায়ের শটে পোস্টের বাইরে মারেন মিসরীয় তারকা। ম্যাচে লিভারপুল তখনো ১-০ গোলে এগিয়ে থাকলেও সালাহর পেনাল্টি মিস দেখে গ্যালারিতে বিস্ময়ে চোখ আরেকটু হলেই খসে পড়েছিল তাঁর ভাইয়ের!
কিন্তু সালাহর ভাইয়ের মতো লিভারপুল সমর্থকদের সেই অবিশ্বাসকে স্বস্তিতে পরিণত করেন ডাচ উইঙ্গার কোডি গাকপো। ৭৬ মিনিটে হেডে গোল করেন। বক্সের ভেতর থেকে আপন মনে লাফিয়ে গাকপো কীভাবে গোলটি করতে পারলেন, সেই প্রশ্নের জবাব দিতে ৮ নভেম্বর রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তির ‘সব সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছি’ বলা নিজের কথাটাই হজম করতে হবে।
ইতালিয়ান এই কোচকে হজম করতে হবে আরও অনেক কিছুই। ৫ ম্যাচে ৩ হার ও ২ জয়ে মোট ৬ পয়েন্ট নিয়ে ৩৬ দলের চ্যাম্পিয়নস লিগ টেবিলে ২৪তম রিয়াল। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নদের এমন অবস্থান আনচেলত্তির নিজেরই হয়তো বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষ ৮ দল সরাসরি জায়গা পাবে শেষ ষোলোয়। ৯ম থেকে ২৪তম দলের মধ্যে প্লে–অফ খেলার মাধ্যমে শেষ ষোলোয় বাকি ৮ দল নিশ্চিত হবে। বিপদ বুঝেও আনচেলত্তি অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমাদের শীর্ষ ২৪–এর মধ্যে থাকতে হবে, আমরা সেটা করব। আগের বছরগুলোর মতোই আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।’
আনচেলত্তির অবশ্য এই ম্যাচে হার নিয়ে রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে আলাপে একটি অজুহাত দেওয়ার সুযোগ থাকছে। চোটগ্রস্ত ফুটবলারদের লম্বা তালিকা। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো, দানি কারভাহাল, এদের মিলিতাও, অঁরেলিয়ে চুয়ামেনি ও ডেভিড আলাবাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারেনি রিয়াল।
লিভারপুল কোচ স্লটের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। রিয়ালকে হারানোটাই যে জরুরি খবর, আপাতত এই ব্যাপারটাই উপভোগ করছেন লিভারপুল কোচ, ‘অনেকবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী একটি দলের বিপক্ষে খেলাটাই বিশেষ ব্যাপার, তার ওপর অনেক বছর ধরেই তারা লিভারপুলের জন্য ছিল “পেইন ইন দ্য অ্যাস”। এই সপ্তাহটা আমাদের জন্য অনেক বড় ও আনন্দের। শেষ ষোলোয় যদি তাদের সঙ্গে দেখা হয় এবং সেখানেও তাদের হারাতে পারলে সেটা হবে বড় বিবৃতি।’
শেষ ষোলো? হ্যাঁ, লিভারপুল এখনই ওই জায়গাটা নিয়ে ভাবতে পারে। ৫ ম্যাচের সবকটি জিতে মোট ১৫ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ টেবিলের নেতৃত্বে স্লটের দল। বাংলাদেশের লিভারপুল সমর্থকেরা হয়তো কাল রাতেই মনের মিছিলে স্লোগান ধরেছেন, ‘মার্কা কি আছে? আছে রে…কোন সে মার্কা? লিভারপুল! লিভারপুল!’