রিজার্ভ, জ্বালানি সংকট, উত্তাপ রাজনীতিতে

0
196
রাজনীতি

বিদায়ের দিন সমাগত। সময়ের নিয়মে আজ বিদায় নেবে আরেকটি বছর। উল্টাতে হবে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির পাতা। আনন্দ-বেদনার দ্বৈরথে চড়ে বিদায় নেবে ২০২২। আগামীকালের ভোরের সূর্যোদয় বার্তা দেবে নতুনের আবাহন। আসবে ২০২৩। মুহূর্তেই স্মৃতিতে পরিণত হবে ফেলে আসা এ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা। তবে নানা বৈচিত্র্যময় ঘটনা-দুর্ঘটনা, সুখ-দুঃখ, আলোচনা-সমালোচনায় ঠাসা ছিল এ বছরটি।

বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর জন্য একটি ঘটনাবহুল বছর শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। যার শুরু হয়েছিল ধারাবাহিক করোনা প্রকোপের মধ্য দিয়ে। গত ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় বাঙালির গর্বের পদ্মা সেতু। খুলে যায় রাজধানীর সঙ্গে সহজ যোগাযোগের জন্য দক্ষিণবঙ্গের দ্বার। নতুন জোয়ার আসে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এ বছরটি শেষ হয়েছে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি নতুন পালক যুক্ত করে, সেটি হলো মেট্রোরেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ ডিসেম্বর এ স্বপ্নযাত্রার উদ্বোধন করেন। করোনার অভিঘাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ছিল টালমাটাল। মুদ্রাস্ম্ফীতি বেড়েছে, বেড়েছে নিত্যপণ্য, জ্বালানি ও বিভিন্ন সেবার মূল্য। এতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বছরের শেষার্ধে দেশের রাজনীতি ছিল সরগরম।

আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ঘটনা ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরপর দ্বিতীয় আলোচিত বিষয় ছিল কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। এ আসরের মধ্য দিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করে আর্জেন্টিনা।

বিদায়ী বছরে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় বছরজুড়ে নানা কর্মসূচি নিয়েও ব্যস্ত ছিল দলটি।

বছরের শেষভাগে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা দশমবারের মতো নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক পদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তৃতীয়বার নির্বাচিত হন। কমিটিতে বেশিরভাগ পুরোনো নেতাই বহাল রয়েছেন। তবে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বরেণ্য ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মুর্তজাকে দলের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক করা নতুন চমক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অন্যদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল গোছানোর দিকেই বেশি নজর ছিল বিএনপির। সেই প্রক্রিয়ার অনেক ধাপ পেরিয়ে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে জনইস্যুতে আন্দোলনে নামে দলটি। এ সময় আন্দোলনের নতুন মাত্রায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করা হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর রাজপথে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

বিএনপির দাবি, ধারাবাহিক এ আন্দোলনে সারাদেশে তাদের ১৫ নেতাকর্মী নিহত হন, সারাদেশে পাঁচ শতাধিক মামলায় ১০ হাজারের ওপরে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ছাড়াও অনেক সিনিয়র নেতা এখনও কারাগারে বন্দি।

তবে বছরের শুরুটা বিএনপি নেতাকর্মীদের কেটেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় টানা ৮১ দিন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে থাকার পর বাসায় ফেরেন তিনি।

এ ছাড়া রাজপথে থাকার টানা কর্মসূচিতে দশ বিভাগীয় শহরে ১২ অক্টোবর থেকে গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে পুরো দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

বিদায়ী বছরে দেশের অর্থনীতি একের পর এক সংকটের মধ্যে পড়েছে। কোনো একটা সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টার মধ্যে নতুন সংকট হাজির হয়েছে। বিদায়ী বছরের শুরু থেকেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ ছিল। ফলে আমদানি ব্যয়ের গতি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের চেয়ে বেশি ছিল। এতে করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশে লেনদেনে অস্বাভাবিক ঘাটতি তৈরি হয়। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে দেশের চলতি হিসাবে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও আইএমএফের ঋণ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা। নতুন অর্থবছরের শুরুতে একই পরিস্থিতি থাকে। ডলারের প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহে বেশ টান পড়ে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখে। কিন্তু বিদায়ী বছরে এক পর্যায়ে এসে অনেকটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমদানি পর্যায়ে ডলারের দর ১১০ টাকার বেশি ওঠে। খোলা বাজারে এক পর্যায়ে ১২০ টাকায় পৌঁছায়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর তীব্র ডলার সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে এবং ডলার খরচ কমাতে এলসি মার্জিন বাড়ানো, কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক্ক আরোপ, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে অর্থ ছাড়সহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বছরের শেষ দিকে ডলারের দামে অস্থিরতা কমে যায়। দাম বেড়ে মোটামুটি স্থিতিশীল হয়েছে। তবে এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। বিদায়ী বছরে আর্থিক খাতের অনিয়মে সামনে এসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ইসলামী ব্যাংক ছাড়া আরও কিছু ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণে বড় অনিয়ম ধরা পড়ে।

২০২২ সালজুড়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় দেশবাসীকে। বাসাবাড়ি থেকে শিল্প-কারখানা- সব খাতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলা করতে হয়। আসন্ন গরম ও সেচ মৌসুমেও বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সংকট ভোগাতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্নিষ্টদের। ২০২২ সালে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ভর্তুকি কমাতে আগামী বছর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়ানো হতে পারে।

২০২২ সালজুড়েই মানবাধিকার ইস্যুতে চাপে ছিল বাংলাদেশ। ২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষত সামলাতে বছরজুড়েই তৎপর ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালে বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিষয়ে প্রায় ১৬টি বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিটি বৈঠকেই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি এ নিষেধাজ্ঞা কাটাতে আইনি প্রক্রিয়াতেও যুক্ত হয়েছে ঢাকা। দেশটিতে আইনজীবী নিয়োগের পাশাপাশি চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও লবিস্ট ও পিআর-এ আলাদা করে বেশ অর্থ খরচ হয়েছে সরকারের।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্ভুল তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিদায়ী বছরের ২৯ আগস্ট সংশোধিত ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২’ সংসদে পাস করা হয়। ওই আইনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রণয়নের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ফলে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশে আর কোনো বাধা রইল না।

এ ছাড়া বিদ্যুৎ সাশ্রয়কে কেন্দ্র করে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নতুন নিয়ম চালু করেছিল সরকার। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস সময় নির্ধারণ হয়েছিল। এর তিন মাসের মাথায় আবারও অফিস সময় পরিবর্তন করে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত করা হয়।

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বৈশ্বিক মন্দা। খাদ্য সংকটের ঢেউ বাংলাদেশে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কায় জোর দেওয়া হয় উৎপাদন বাড়ানোর ওপর। কিন্তু শেষ ভরসা কৃষি খাত পার করেছে দুঃসময়। বোরো মৌসুমে বন্যা কেড়ে নেয় কৃষকের স্বপ্ন। এরপর সারের উৎপাদন ও চাহিদা স্বাভাবিক থাকলেও কারসাজি করে তৈরি করা হয় কৃত্রিম সংকট।

এর মধ্যে বছরের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতাও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সংকট কাটার কোনো লক্ষণ ছিল না। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘ হয়। খাদ্য সংকটের আশঙ্কা জানিয়ে পূর্ভাবাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। প্রধানমন্ত্রীও দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন বারবার। এত নেতিবাচক খবরের মাঝে কিছু স্বস্তির সংবাদও আছে। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আমন ধানের উৎপাদনে এসেছে সুবাতাস।

সাব্বির নেওয়াজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.