রান্না দেখে, পার্কে ঘুরে ‘ইউটিউব ভিলেজে’ আনন্দযাত্রা

0
115
দুটি ইউটিউব চ্যানেলের আধেয় তৈরি হয় শিমুলিয়া গ্রামে। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ইউটিউব ভিলেজ নামে

বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে। পাড়ার নারী-পুরুষেরা সবাই ব্যস্ত। আঙিনা থেকে কয়েক পা এগোলেই পার্কের প্রবেশদ্বার। ভেতরে ঢোকার পর মন ভরে যায়। গাছগাছালি আর ফুলে ভরা পুরো এলাকা। ছোট ছোট আমগাছ, বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে বাঁ পাশে বড়সড় পুকুর। পানিতে ভাসছে রংবেরঙের ছোট ছোট নৌকা। হ্রদের ওপর লতাপাতা-ফুলে ঘেরা বাঁশ-কাঠের তৈরি সাঁকো। লেকের পাড়ে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলো গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি।

দৃষ্টিনন্দন এমন আয়োজন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। অবশ্য লোকে এখন গ্রামটিকে চেনে ‘ইউটিউব ভিলেজ’ নামে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণাও চলে এই নামেই। ‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ ও ‘ভিলেজ গ্র্যান্ডপাস কুকিং’ নামে দুটি ইউটিউব চ্যানেলের আধেয় তৈরি হয় এই গ্রাম থেকে। চ্যানেলের মূল ভিডিও চিত্রে থাকে রান্নার আয়োজন। তা থেকেই আসে লাখ লাখ টাকা। গ্রামের বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই ইউটিউব চ্যানেল থেকে। এর পর থেকে শিমুলিয়া পরিচিতি পেয়েছে ইউটিউব ভিলেজ নামে।

গ্রামটি নিয়ে ২০২০ সালের ৭ নভেম্বর ‘শিমুলিয়া এখন ইউটিউব গ্রাম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। কেমন আছেন অ্যারাউন্ড মি বিডি ও ভিলেজ গ্র্যান্ডপাস কুকিংয়ের মানুষেরা! সেই পথচলার অগ্রগতি জানতে ও দেখতে সম্প্রতি এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন শিমুলিয়া গ্রামে।

বাড়ির সামনে পতিত জমিতে গড়ে তোলা হয় বিনোদন কেন্দ্র। যার নাম দেওয়া হয় ‘ইউটিউব ভিলেজ পার্ক’
বাড়ির সামনে পতিত জমিতে গড়ে তোলা হয় বিনোদন কেন্দ্র। যার নাম দেওয়া হয় ‘ইউটিউব ভিলেজ

খোকসা উপজেলা বাজার থেকে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়ক ধরে এগোলে বিলজানি এলাকায় বাঁ পাশে সরু পাকা একটি সড়ক চোখে পড়বে। সেই সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পর শিমুলিয়া। গ্রামটিতে সাতটি পাড়া। এর একটি পাড়ার নাম মোল্লাপাড়া। এই পাড়ার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন। দেলোয়ার হোসেন স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। দেলোয়ারের ভাগনে লিটন আলী হলেন ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মালিক। তিনিই ঢাকা থেকে চ্যানেল দুটি পরিচালনা করেন।

চৈত্রের তপ্ত দুপুরে বাড়ির সামনে বাঁশের তৈরি মাচায় বসে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। পরিচয় দিতেই হেসে উঠলেন। বললেন, কত দিন পর এলেন। ইউটিউব ভিলেজ তো আরও বদলে গেছে। তাঁকে নিয়েই গোটা গ্রাম ঘুরলেন এই প্রতিবেদক।

কথা প্রসঙ্গে দেলোয়ার জানালেন, চ্যানেলে ভিডিও দিতে প্রতি মাসেই একাধিকবার রান্নার আয়োজন করা হচ্ছে। রমজান মাসের আয়োজন একটু ব্যতিক্রম। আশপাশের এতিমখানা ও মাদ্রাসায় গিয়ে রান্না করা হচ্ছে। তাদের বিনা মূল্যে খাওয়ানো হচ্ছে। এই কাজে পাড়ার অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ সম্পৃক্ত। তাঁদের মধ্যে নারী আছেন অন্তত ২০ জন। তাঁদের প্রত্যেককে মাসিক তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। খাবারও দেওয়া হয়। আর রান্নার দিন তো পাড়ার বাড়িগুলোতে চুলা বন্ধ থাকে।

রেহেনা খাতুন জানালেন, রান্না করতে ভালো লাগে। বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে রান্না করে খাচ্ছেন। আবার মাস শেষে বেতন পাচ্ছেন। এতে তিনি বেশ আনন্দ পান। একই কথা বললেন আসমা খাতুন নামে আরেক নারী। তাঁদের একই ধরনের পোশাকও দেওয়া হয়।

পার্কে ফ্যামিলি ট্রেন, প্যাডেল বোট, ফুলের বাগান, ক্রিয়েটিভ ক্র্যাফটস এবং সব বয়সী মানুষের জন্য মজাদার রাইড রয়েছে
পার্কে ফ্যামিলি ট্রেন, প্যাডেল বোট, ফুলের বাগান, ক্রিয়েটিভ ক্র্যাফটস এবং সব বয়সী মানুষের জন্য মজাদার রাইড রয়েছে

দৃষ্টিনন্দন পার্ক

রান্নার আয়োজন দেখতে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ জড়ো হন। ভিড় বেড়ে যায়। সারা দিনের কর্মযজ্ঞ দেখেন তাঁরা। মানুষের চাওয়া থেকেই দেলোয়ারের বাড়ির সামনে পতিত জমিতে গড়ে তোলা হয় বিনোদন কেন্দ্র। যার নাম দেওয়া হয় ‘ইউটিউব ভিলেজ পার্ক’।

ইউটিউব ভিলেজ পার্কটি সারা সপ্তাহ সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে
ইউটিউব ভিলেজ পার্কটি সারা সপ্তাহ সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে

মাত্র এক বছরে এই পার্ক বেশ পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন কয়েক শ নারী-পুরুষ ও শিশু এই পার্কে আসেন। প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত একটি পরিবারবান্ধব পার্ক এটি। পার্কে ফ্যামিলি ট্রেন, প্যাডেল বোট, ফুলের বাগান, ক্রিয়েটিভ ক্র্যাফটস এবং সব বয়সী মানুষের জন্য মজাদার রাইড রয়েছে। পার্কের চারপাশ ঘিরে আছে দৃষ্টিনন্দন নানা প্রজাতির ফুলের গাছ। পার্কের ভেতরে গরু, হাতি, কচ্ছপ, ডাইনোসরসহ নানা প্রাণীর অবয়ব তৈরি করা হয়েছে খড় ও বাঁশ দিয়ে। গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট ঘর।

পার্কটি সারা সপ্তাহ সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্র ও শনিবার সপ্তাহের ব্যস্ততম দিন থাকে। এখানে শীতকালে বা মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বেশি লোকসমাগম থাকে।

বিশেষ উৎসব ঈদ, পূজার পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের মতো দিনগুলোতে পার্কটিতে ভিড় জমে। পার্কটির এন্ট্রি ফি জনপ্রতি ৩০ টাকা এবং রাইডের ফি ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। পার্কটিতে অন্তত ৭০ জন কর্মী আছেন। এর মধ্যে দেলোয়ার লিটনের পরিবারের সদস্য রয়েছেন ২০ জন।

ঈদ, পূজার পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের মতো দিনগুলোতে পার্কটিতে ভিড় জমে
ঈদ, পূজার পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের মতো দিনগুলোতে পার্কটিতে ভিড় জমে

দেলোয়ার হোসেন জানান, এই ঈদে পার্ক খোলা থাকবে। পাশাপাশি বাড়ির সামনে থাকবে রান্নার আয়োজন। তবে পার্কের সামনে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ কাঁচা সড়কটি পাকা হলে সরাসরি মহাসড়কে যাওয়া যেত।

রান্নার আয়োজন থেকে শুরু করে পার্ক পরিচালনার কাজ গ্রামে থেকে করেন মামা দেলোয়ার হোসেন। আর ঢাকায় বসে লিটন আলী ও তাঁর ছোট মামা সামারুক হোসেন ভিডিও সম্পাদনাসহ চ্যানেলে ভিডিও আপলোডের কাজ করেন।

লিটন আলী বলেন, পরিকল্পনা ছাড়া গড়ে তোলা ইউটিউব চ্যানেলের পরিধি আরও বেড়েছে। গ্রামের মানুষের সুস্থ ধারার বিনোদনের জন্য গড়ে তোলা পার্কে আরও নতুন নতুন রাইড যুক্ত হচ্ছে। ইউটিউব চ্যানেল শখের বশে চালু করলেও এর পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে। অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.