রাজধানী তো বটেই, জেলা-উপজেলা আর বিভাগীয় নগরও এখন ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে বেশ। লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। চিকিৎসা উপকরণের অপ্রতুলতায় অতিরিক্ত রোগী সামাল দিতে খেই হারাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তের কিট ও শিরায় দেওয়া স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের অনেক চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে রোগী ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। জটিল রোগীর জন্য প্লাটিলেট আলাদাকরণে ব্যবহৃত অ্যাফেরেটিক যন্ত্র নেই অধিকাংশ হাসপাতালে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি নষ্টের কারণে কিছু কিছু হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও স্বজনরা। বেসরকারি হাসপাতালে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে কয়েক গুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।
এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা-উপজেলা থেকে ডেঙ্গু রোগী ঢাকায় না পাঠাতে নির্দেশনা দিয়েছে। সরকারি সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এখন থেকে জটিল রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে নিশ্চিত করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার যৌক্তিকতা রয়েছে, তবে জেলা-উপজেলার হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনের পাশাপাশি চিকিৎসকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীর উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, জেলা-উপজেলা হাসপাতালে দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন। তবে তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও উন্নত করতে হবে। ফ্লুইড ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে উপকরণের ঘাটতি ও যন্ত্রপাতি সচলে আরও সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরির সিন্ডিকেট শনাক্তে সরব ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির জানান, সব সিভিল সার্জনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি হাসপাতালে র্যাপিড রেসপন্স টিম তৈরি করে। এই টিম যারা অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থার রোগী, তাদের প্রতিনিয়ত দেখভাল করবে। রোগীর অবস্থা যাতে আরও খারাপ না হয় এবং এ রকম রোগীকে ঢাকার দিকে যেন পাঠাতে না হয়, সেটিও এই টিম তদারকি করবে।
চট্টগ্রামে স্যালাইন নিয়ে অরাজকতা
ডেঙ্গু রোগীর জন্য শিরায় দেওয়া স্যালাইন নিয়ে বন্দরনগরীতে চলছে অরাজকতা। স্যালাইনের চাহিদা বাড়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগী-স্বজনরা। ৮৭ টাকার একটি স্যালাইন ৩০০ টাকার কমে মিলছে না। চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ১২০ জনের ওপর নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ছুঁইছুঁই। মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্যালাইন নিয়ে কারসাজিতে রয়েছে প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান। এর নেপথ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের বড় তিন বাজারের কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী। অনেকের ব্যাপারে এরই মধ্যে কারসাজির প্রমাণও পেয়েছে প্রশাসন। জড়িতদের চিহ্নিত করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ চলমান থাকার কথা বলছেন দায়িত্বশীলরা। স্যালাইনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে চট্টগ্রামের বৃহৎ ওষুধের মোকাম হাজারীগলি, চমেক হাসপাতাল ও বহদ্দারহাট হক মার্কেটের অসাধু ব্যবসায়ীরা। কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে সাহান মেডিকো, সবুজ ফার্মেসি, ইমন মেডিকেল হল, পপুলার মেডিসিন কর্নার, বেঙ্গল ফার্মেসি, চট্টলা ফার্মেসি, মেসার্স এনএম ফার্মা, এস মেডিকো, সবুজ ফার্মাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। নানা কৌশলে তারা কোম্পানি থেকে বাড়তি স্যালাইন সংগ্রহ করে তা মজুত করছে। এ কারণে এক ফার্মেসি থেকে অন্য ফার্মেসি ঘুরেও প্রয়োজনীয় স্যালাইন পাচ্ছেন না রোগী-স্বজনরা। পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ দাম। পরিচয় গোপন রেখে রোববার দুপুরে চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেটের সামনে থাকা সাহান মেডিকো, মেসার্স ইমন মেডিকেল, জয়নাব মেডিকেল হল, সেবা মেডিকেলসহ বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে স্যালাইনের জন্য যান এই প্রতিবেদক।
এ সময় প্রত্যেকেই একবাক্যে বলেন, ‘স্যালাইন নাই।’ খুব জরুরি বললে ইমন মেডিকেলের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘পাওয়া গেলেও দাম পড়বে ৩০০ টাকা।’ এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশই প্রতিদিন ভর্তি হয় এসব হাসপাতালে।
স্যালাইনের দাম বাড়ার খবর পেয়ে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারি ওষুধের বাজার হাজারীগলিতে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবরে দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। এ সময় হাজারীগলির খাজা মার্কেটের একটি দোকান থেকে লক্ষাধিক টাকার স্যালাইন জব্দ করা হয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী বাড়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও প্রয়োজনমতো স্যালাইন পাচ্ছেন না রোগী ও স্বজনরা।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এস এম সুলতানুল আরেফিন বলেন, ‘দেশে পাঁচটি ওষুধ কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা আমাদের জানিয়েছে, তারা পর্যাপ্ত স্যালাইন উৎপাদন ও চাহিদামতো সরবরাহও করছে। তবু কারসাজি করে কয়েক গুণ টাকা আদায় করা হচ্ছে। হাজারীগলির ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইজি ওয়ানের স্বত্বাধিকারী সৈকত চৌধুরী বলেন, ‘কোম্পানিগুলো চাহিদামতো স্যালাইন সরবরাহ করছে না। তবে তারা হাসপাতাল এলাকার চারপাশে থাকা ফার্মেসিতে বিপুল পরিমাণ স্যালাইন সরবরাহ করছে।’
কিট সংকটে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিট সংকটে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করতে গিয়ে স্বজনদের ভোগান্তি ও বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইউনুস আলী বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, হাসপাতালেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। তবে কিট সংকট রয়েছে। নতুন কিট এলেই আবার পরীক্ষা শুরু হবে। এই সপ্তাহের মধ্যে হয়তো কিট চলে আসবে। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালেও ডেঙ্গু কিট সংকট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে চাহিদা চাওয়া হয়েছে। নতুন কিট না আসা পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে যন্ত্র বিকলের কারণে পরীক্ষা বন্ধ আছে ১৫ দিন। এ কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অতিরিক্ত টাকা খরচের পাশাপাশি বিপাকে পড়ছেন রোগী ও স্বজনরা।
এদিকে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে মাগুরায়। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। মাগুরার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড চালু হলেও নেই পর্যাপ্ত শয্যা। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, ওষুধের ব্যবস্থা। অর্ধেকের বেশি রোগীকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে মেঝেতে।