রণতরিসহ ডজনখানেক যুদ্ধজাহাজ ও ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হামলা কি আসন্ন

0
14
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পৌঁছেছে, ফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভেনেজুয়েলায় হামলা চালানোর বিষয়ে তিনি অনেকটাই মনস্থির করে ফেলেছেন। সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তারা তাঁকে কয়েক দফায় এ বিষয়ে ব্রিফ করেন। এরপর তিনি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করা হয়েছে।

চারটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন বলেছে, মার্কিন কর্মকর্তারা চলতি সপ্তাহে ভেনেজুয়েলায় সামরিক অভিযান পরিচালনার বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ট্রাম্পকে ব্রিফ করেন। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিস্তৃত অভিযান শুরু করলে কী কী লাভ-ক্ষতি হতে পারে, তা পর্যালোচনা করছেন তাঁরা।

এদিকে, ‘অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার’ নামে পেন্টাগন ঘোষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ১২টির বেশি যুদ্ধজাহাজ এবং ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী।

গত শুক্রবার ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে অবৈধ অভিবাসীর ঢল ও মাদক পাচার বন্ধ করতে তিনি তাঁর লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন। এয়ারফোর্স ওয়ান উড়োজাহাজে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি অনেকটা মনস্থির করে ফেলেছি। সেটা কেমন হবে, আমি আপনাদের ঠিক বলতে পারছি না, তবে আমি একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।’

ট্রাম্পকে কর্মকর্তারা কী বলেছেন

বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনসহ মার্কিন কর্মকর্তাদের ছোট একটি দল ট্রাম্পকে ব্রিফ করে। এরপর বৃহস্পতিবার ‘সিচুয়েশন রুমে’ বড় পরিসরে জাতীয় নিরাপত্তা দলের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক হয়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ অন্য শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

দুটি বৈঠকেই ট্রাম্প ও তাঁর কর্মকর্তারা সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন। ট্রাম্পকে ভেনেজুয়েলা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন বিকল্প পথ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বা সরকারি স্থাপনায় বিমান হামলা, মাদক পাচারের রুটগুলোয় হামলা অথবা মাদুরোকে উৎখাতে আরও সরাসরি প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বলা হয়েছে। এর আগে সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভেনেজুয়েলার ভেতরে কোকেন উৎপাদনকেন্দ্র এবং মাদক পাচারের রুটগুলো লক্ষ্য করে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে ট্রাম্প ভাবছেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পৌঁছেছে। এই রণতরি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫ হাজার সদস্য এবং ১ ডজনের বেশি যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে সরেও আসতে পারেন ট্রাম্প। গত মাসে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি সিআইএকে (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) দেশটিতে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে আইনপ্রণেতাদের বলেছেন, ভেনেজুয়েলার ভেতরে স্থল অভিযান চালানোর পক্ষে কোনো আইনি ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই। যদিও প্রয়োজন হলে তাঁরা এমন আইন তৈরি করে নিতে পারেন। সমপ৶তি ট্রাম্প সিবিএসের ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ভেনেজুয়েলার ভেতরে হামলার কথা ভাবছেন না। যদিও এর আগে তিনি এ ধরনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

ট্রাম্পের বৈঠকের বিষয়ে অবগত সূত্র বলছে, ব্যর্থ হতে পারে বা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপের ব্যাপারে আদেশ দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পকে সতর্ক বলে মনে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফাইল ছবি: এএফপি

কী ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে তাদের নৌ সেনাদের মোতায়েন করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন অন্তত ২০টি সন্দেহজনক মাদক পাচারকারী নৌকায় হামলা চালিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের প্রবাহ বন্ধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে তাঁরা এসব হামলা চালিয়েছেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পৌঁছেছে। এই রণতরি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫ হাজার সদস্য এবং ১ ডজনের বেশি যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে একটি ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার, একটি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কমান্ড জাহাজ, জলে ও স্থলে দুই জায়গাতেই হামলা চালানোর সক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ এবং একটি সাবমেরিন।

এটা নজিরবিহীন। চলতি শতাব্দীতে (এ অঞ্চলে) এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক প্রস্তুতি। আসলে একই ধরনের ঘটনার নজির খুঁজতে গেলে ১৯৮৯ সালে পানামায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়।

এরিক ফার্নসওয়ার্থ, গবেষক, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধুনিক ১০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান পুয়ের্তো রিকোতে পাঠিয়েছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে বাড়তি নজরদারির অংশ হিসেবে পুয়ের্তো রিকো মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এই সামরিক সমাবেশকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক এরিক ফার্নসওয়ার্থ সিএনএনকে বলেন, ‘এর (সেনা সমাবেশ) মাত্রা ও গতি উভয় নিয়েই আমি বিস্মিত। এটা নজিরবিহীন। চলতি শতাব্দীতে (এ অঞ্চলে) এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক প্রস্তুতি। আসলে একই ধরনের ঘটনার নজির খুঁজতে গেলে ১৯৮৯ সালে পানামায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির জবাবে ভেনেজুয়েলা বলেছে, তারা ব্যাপকহারে অস্ত্র ও সরঞ্জাম এবং সেনা মোতায়েন শুরু করেছে।

সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি

ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তবে মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলে ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগী দল এমন একটি অর্জনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে, যা বহু মার্কিন প্রশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও এমনটাই হতে দেখা গেছে।

প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে দেশটির বৈধ নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে ২০১৯ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর গুয়াইদো কখনোই ক্ষমতা গ্রহণে সক্ষম হননি।

ট্রাম্প যদি মাদুরোকে উৎখাত করতে পারেন, তাহলে তিনি কয়েকটি বড় সাফল্যের দাবি করতে পারেন। সেগুলো হলো একজন ক্ষমতাধর নেতাকে সরিয়ে নির্বাচিত নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা, মাদক ও অভিবাসীর ঢল ঠেকাতে দুদেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ এবং জ্বালানি তেল নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তির পথ খুলে দেওয়া।

তবে মাদুরোকে সরাতে ভেনেজুয়েলার ভেতরে হামলার নির্দেশ দিলে ট্রাম্প গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তবে মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলে ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগী দল এমন একটি অর্জনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে, যা বহু মার্কিন প্রশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও এমনটাই হতে দেখা গেছে।

শুক্রবার কারাকাসে দেওয়া ভাষণে মাদুরো সতর্ক করে বলেছেন, মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ লাতিন আমেরিকায় ‘আরেকটি গাজা’, নতুন আফগানিস্তান বা আবার ভিয়েতনাম পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি বার্তা দিয়ে মাদুরো বলেন, ‘যারা দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বোমা হামলা, হত্যা ও যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেয়, তাদের উন্মত্ত হাত থামাও। যুদ্ধ থামাও। যুদ্ধকে “না” বলো।’

এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন সেনা মোতায়েন রাখার বিষয়টি ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করা রাজনৈতিক জোটকেও বিরক্ত করে তুলতে পারে। কারণ, এ জোট দেশের বাইরে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তাঁকে সমর্থন করেছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ— দুজনই ইরাক যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে দেশের বাইরের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানো নিয়ে অনীহা দেখিয়ে আসছেন।

সিএনএন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.