বলা হয়ে থাকে, ঢাকার মাদানী অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশেই গড়ে উঠবে ভবিষ্যৎ ঢাকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও আবাসন। সেই ভবিষ্যৎ, টেকসই প্রযুক্তি আর আগামীর বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে ইউনাইটেড হাউস। ইউনাইটেড গ্রুপের সদর দপ্তর দেখতে গিয়েছিলেন জাহিদ হোসাইন খান
১০ বিঘা সবুজের মধ্যে গড়ে উঠেছে ইউনাইটেড হাউস। বইপুস্তকে একটি পরিপূর্ণ করপোরেট স্থাপনার যে সংজ্ঞা আছে, তার প্রায় সব শর্তই পূরণ করেছে আধুনিক এই অফিস। অফিস মানেই তো কাজকর্ম, কর্মীরা সেই কাজে যেন উদ্দীপনা পান, কর্মপরিবেশ যেন হয় উৎসাহব্যঞ্জক, পুরো অফিসের স্থাপত্যে এই ভাবনাটার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটির বিন্যাস করেছেন প্রধান স্থপতি নাহাস আহমেদ, প্রকল্প স্থপতি রেহমান তাকি ফেরদৌস ও মো. আসাদুজ্জামান।
চারটি ব্লকে একেকটি ফ্লোরে নানান কাজের নানা অফিস। ফ্লোরভেদে অফিস আয়তন সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার বর্গফুট। এ ছাড়া দুই হাজার বর্গফুটজুড়ে রাখা হয়েছে সবুজের আবহ। স্থপতি নাহাস আহমেদ বললেন, ‘নগরায়ণের ধাক্কা এখনো এখানে এসে পৌঁছায়নি। বিদ্যমান সবুজ ল্যান্ডস্কেপের মধ্যেই একটি অফিস স্থাপনা করার দর্শন নিয়ে কাজ শুরু করি আমরা, ভবনকে ছাপিয়ে যেখানে সবুজ গাছপালা প্রধান্য পাবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যাঁরা করপোরেট দপ্তর তৈরি করবেন, তাঁদের সামনে একটি উদাহরণ হিসেবে আমরা নিজেদের কাজটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।’
স্থপতি রেহমান তাকি ফেরদৌস জানালেন, ‘৫ থেকে ৭ বছর পর ভবন ছাপিয়ে সবুজ যখন আরও আধিপত্য বিস্তার করবে, তখন আরও বেশি করে বোঝা যাবে, কোন ভাবনা থেকে গড়ে উঠেছে ইউনাইটেড হাউস।’
জনবহুল শহরে ভবন সাধারণত ওপর দিকে বাড়তে থাকে, ইউনাইটেড হাউস অনুভূমিকভাবে বেড়েছে। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে দুই পাশেই বিশাল প্রান্তর। সবুজ ঘাসের প্রাঙ্গণের শেষ মাথায় কংক্রিটের স্থাপনা। রাস্তা আর সবুজ পেরিয়ে সদর দপ্তরের মূল ভবনে প্রবেশ করতেই বিশাল লবি। মাথার ওপরে বিশাল স্থাপনা, দুই পাশে গ্লাসের বেষ্টনী। দেয়ালজুড়ে নেমে এসেছে নানা রকম লতানো গাছ। শান্ত-স্নিগ্ধ আবহে যার যার কাজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। দূর থেকে মনে হবে, বনের এক প্রান্তে অফিস। স্থপতি রেহমান তাকি ফেরদৌস বলেন, ‘দূর থেকে মনে হবে, গাছের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা একটি ভবন। সাধারণত ভবন নির্মাণ করে সেখানে সবুজায়ন করা হয়। আমরা চেয়েছি যেন সবুজ গাছে ঘেরা বড় একটি অঞ্চলে ভবন নির্মাণ করলে যতটা সবুজের প্রাধান্য রাখা হতো, তেমনটা করতে।’
ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান স্থপতি ফয়সাল মাহবুব জানান, ‘৬৪০ ঘনফুট অভ্যর্থনার জায়গাটি চারতলা সমান। ভবনে প্রবেশের পর চারপাশে বড় বড় গাছ, মনে হবে যেন সবুজের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছি আমরা। দুই পাশের বিশাল কাচের দেয়ালের কারণে দিনের পুরোটা সময়ই প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ভবনের গাছে ভরা বারান্দায় দাঁড়ালে বিস্তৃত ঢাকা শহরের দিকে চোখ পড়ে। সবুজের এই সীমানায় দাঁড়িয়ে রাজধানীকে দেখতে লাগে অন্য রকম।’
স্থাপনাটির ঠিক পাশেই বালু নদ থেকে আসা একটি প্রাকৃতিক জলাধার ছিল। সংস্কার করে জলাধারটিকে ভবনের মধ্যেই প্রবেশ করানো হয়েছে। ওপর থেকে মনে হয়, অফিসের একটি অংশ যেন হ্রদের মধ্যে ভাসছে।
ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান স্থপতি ফয়সাল মাহবুব জানান, স্থাপনা নির্মাণে প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সর্বত্র। আর কয়েক বছরের মধ্যে যখন সব গুল্ম-গাছ বড় হয়ে যাবে, দূর থেকে ভবনটিকে তখন আর ভবন হিসেবে চেনাই যাবে না। ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে গাছপালায় ঘেরা আধুনিক আবাস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে পুরো সদর দপ্তর।
ইউনাইটেড হাউস নির্মাণের পরিকল্পনা হয় ২০১৬ সালে। আর ২০২০ সালে এই ভবনে নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হয়। মাদানী অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত এই স্থাপনায় এখন পুরোদমে কাজ করেন কর্মীরা। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরাও এখান থেকেই সব কাজ করছেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেফস টেবিলসহ আউটিং করার মতো বেশ কয়েকটি জায়গার কল্যাণে এলাকাটি এখনই সাধারণ মানুষের নিয়মিত গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে এদিকের রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়বে। ভবন নির্মাণের সময় এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ভবনটি এমনভাবে সবুজে ঘেরা যে রাস্তার গাড়ির শব্দ ভবনের ভেতরে প্রায় ঢোকেই না। প্রতিটি ফ্লোরে আলাদা বারান্দা দিয়ে বাগান ও সবুজ গাছের বেষ্টনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভবন নির্মাণে ক্রস ভেন্টিলেশন, ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ওপেন স্পেস ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সদর দপ্তরের আলাদা ব্লকগুলো আবার স্টিল স্থাপনায় তৈরি তিনটি ব্লকের মাধ্যমে যুক্ত।
ফয়সাল মাহবুব জানান, সংযোগকারী ব্লকগুলোকে মিটিং রুম, দাপ্তরিক কাজ এবং অভ্যন্তরীণ আলাপ–সাক্ষাতের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভবন থেকে যেদিকেই তাকানো যায়, মিলবে সবুজ প্রান্তর। রাজধানী ঢাকায় দৃষ্টিসীমানায় অধিকাংশ সময় যেখানে অন্য ভবন চলে আসে, সেখানে এখানে মিলবে সবুজ আর সবুজ।
আধুনিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্দরসংশ্লিষ্ট অহেতুক বিষয়গুলোকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা হয়েছে। কর্মীদের মনোযোগ ও সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভবনজুড়েই শান্ত ও সাবলীল পরিবেশ বজায় রাখা হয়েছে। পুরো অফিস এলাকার যেকোনো জায়গা থেকে যেন সবুজ উপভোগ করা যায়, সেই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এখানে সব সময় প্রাকৃতিক আলোর সঙ্গ থাকে। প্রতিটি ফ্লোরেই চেয়ার–টেবিলের বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে যেন কর্মীদের সামনে বিশাল জায়গা থাকে। সবুজকে সব দিক থেকেই কাজের টেবিলের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে যেন কাজের বিরতিতে সবুজের সঙ্গ নিতে পারেন কর্মীরা, জানালেন প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্র্যান্ড কর্মকর্তা আরিফ হোসেন। অফিসের অন্দরসজ্জাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। অফিসের মধ্যেই এখানে–সেখানে বসার জায়গা, বড় কর্মী জমায়াতের জন্য লন আর ডাইনিং স্পেস।
বিভিন্ন মিটিং রুমের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন কখনোই মনে না হয় ভিড়ভাট্টা আর কোলাহল। মিটিং স্পেসে অনলাইন মিটিংয়ের নানা ব্যবস্থাও আছে। বিভিন্ন কর্নারে অনেকটা ইচ্ছা করেই যেন গ্লাসের মাধ্যমে উন্মুক্ত প্রান্ত দেখার সুযোগ রাখা হয়েছে। উন্মুক্ত পরিবেশে কাজের গুণগত মান ভালো হয়, কর্মীদের মধে৵ তৈরি হয় আস্থা ও কর্মচাঞ্চল্যপূর্ণ সম্পর্ক। কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের সৃজনী শক্তি বিকাশে স্থাপনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে।
সদর দপ্তর মানেই কিন্তু কাজের চাপ। কাজের ভারে কর্মীরা যেন হারিয়ে না যান, সেই জন্য অফিসজুড়েই আছে একা কিংবা দলীয়ভাবে বসার সুযোগ। হাতে কফির কাপ নিয়ে অনেককে অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে মাথা খাটাতে দেখা গেল।
জেনারেশন জি প্রজন্মের তরুণ কর্মীরা আধুনিক মিনিমাল কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পছন্দ করেন। পুরো ইউনাইটেড হাউসেই তাই আধুনিক মিনিমাল আসবাব। বিভিন্ন দেয়ালে নানান ধরনের চিত্রকর্মের পাশাপাশি ডিভাইডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে দেশীয় জামদানি। নানান কাজের জায়গায় নানান রঙের আবহ। পুরো এলাকাজুড়েই বাংলাদেশের নানান সংস্কৃতি, ইতিহাস-অনুষঙ্গকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। সদর দপ্তরে নানান দেশের নানান গ্রাহকের আগমন ঘটে। তাদের সামনে বাংলাদেশকে নান্দনিক ও আধুনিকভাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা বিভিন্ন দেয়ালজুড়েই দেখা যায়।
বাংলাদেশের মতো দেশে দিনের সব কাজের জন্য সূর্যের আলোই যথেষ্ট। ইউনাইটেড হাউস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন দিনের বেলায় ব্যবহারকারীকে কোনো বৈদ্যুতিক বাতির ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়। আর ব্লকগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে সবুজ অরণ্যে বায়ু চলাচলের যে আবহ থাকে, পুরো এলাকায় সেই আবহ মিলবে।
সাধারণভাবে শহরের অফিসগুলোতে হাঁটাচলার সুযোগ অনেক সীমিত। এই স্থাপনায় কর্মীদের নিয়মিত হাঁটতেই হবে। এই অফিস প্রাঙ্গণ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন কর্মীরা সিঁড়ি বা সংযোগ ব্লকগুলো ব্যবহার করে হাঁটাহাঁটির সুযোগ পান।
এই ভবন প্রাঙ্গণ থেকেই আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে নানান উদ্ভাবনী কাজ করে চলেছেন অভিজ্ঞ পেশাজীবী ও তরুণ কর্মকর্তারা।