শীতকালে বুড়িগঙ্গার পানি কমতে থাকে। এতে নদীর আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। এ মৌসুমে ঢাকার পাশের এই নদীর পানি যতটুকু চোখে পড়ে, তা কুচকুচে কালো। যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় আবর্জনার স্তূপ। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার এমন মরণদশা নতুন নয়, দেশের আরও ৫৬টি নদীও এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নদীর পানির মানদণ্ড ভালো হলেও সবগুলোই প্লাস্টিক ও শিল্প বর্জ্যের আগ্রাসনের শিকার। এক সময়ের টলটলে পানির নদীগুলো চরম দূষণে মৃতপ্রায়। আর গত ৫০ বছরে দখল-দূষণে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ভয়াবহ বিপদের এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘নদীর অধিকার রক্ষা কর’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীকৃত্য নয়, যেন নদীর শেষকৃত্য করা হচ্ছে। দখল-দূষণে দিনে দিনে মরছে নদী। সরকারকে নদ-নদী বাঁচাতে খুব দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
নদীবিষয়ক সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৫৬টি নদীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে। স্বাস্থ্য ও জলজ চরিত্র বিশ্লেষণ করে এক-তৃতীয়াংশ নদীতে অতিমাত্রায় দূষণ খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্লাস্টিক ও শিল্প বর্জ্য পাওয়া নদীগুলো হলো– বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, ইছামতী (মুন্সীগঞ্জ), মেঘনা, খিরু (গাজীপুর), শিলা (গাজীপুর), লবণদহ (গাজীপুর), লোয়ার বানার (ময়মনসিংহ, গাজীপুর), পুরোনো ব্রহ্মপুত্র (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী), পশুর (খুলনা), তিতাস (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), বংশী (গাজীপুর, টাঙ্গাইল), চিলাই, কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম), সুতাং (সিলেট), খোয়াই (সিলেট), বাকখালী (কক্সবাজার), ভৈরব (খুলনা, যশোর), মাতামুহুরী (কক্সবাজার), রূপসা (খুলনা), সুরমা (সিলেট), আত্রাই (রাজশাহী), ময়ূর (কুষ্টিয়া), চিংড়ি, হালদা, নাফ, বংশী (সাভার), করতোয়া, ফেনী, আলাইকুড়ি (রংপুর, খুলনা), ঘাঘট (রংপুর), খোকসাঘাঘট (রংপুর), শ্যামাসুন্দরী খাল (রংপুর), সোনাই (বরিশাল, পটুয়াখালী), কড়াংগি (হবিগঞ্জ), কাঠি, যাদুকাটা (হবিগঞ্জ অংশ), হাড়িধোয়া (নরসিংদী), চিত্রা (নড়াইল), মাথাভাঙ্গা (চুয়াডাঙ্গা), রূপসা, কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, পায়রা, বিষখালী, ভোলা খাল, রামনাবাদ, আন্ধারমানিক, খাপড়াভাঙ্গা, বলেশ্বর, সুতিয়া (গাজীপুর, ময়মনসিংহ) ও কর্ণতলী।
এসব নদীতে তিনটি নিয়ামকের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়। এগুলো হলো– দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও), বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ও কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি)। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল সাধারণ মানদণ্ড প্রতি লিটারে ৪.৫ থেকে ৮ মিলিগ্রামের বিপরীতে প্রতি লিটারে ০.৪ থেকে ৭৭ মিলিগ্রাম। সাধারণ মানদণ্ড লিটারে ৫০ মিলিগ্রামের বিপরীতে জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা ছিল প্রতি লিটারে ১.০২ থেকে ৭৩ পর্যন্ত। প্রতি লিটারে রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা ছিল সর্বনিম্ন ২১ থেকে সর্বোচ্চ ১৫৪ পর্যন্ত।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। শুধু দূষণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে দখল ও অন্যান্য বিষয় আমলে নেওয়া হয়নি। জরিপ চালানো মোট নদীর ৭০ শতাংশের পানির গুণগত মানের প্রতিটি নিয়ামকের পরিমাণ সাধারণ মানদণ্ডের মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। বাকি ৩০ শতাংশের পানির মান ভালো হলেও সবগুলোতেই প্লাস্টিক ও শিল্প বর্জ্যের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।
প্লাস্টিকসহ অন্যান্য দূষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) বাংলাদেশের মহাসচিব শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর মতো অন্য বড় শহরের নদীগুলোয়ও প্লাস্টিকের দূষণ তীব্র হয়েছে।
২০১৫ সালে প্রকাশিত পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার আশাপাশে ৮০ থেকে ১০০টি কারখানা প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক ৬০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে ছাড়ে। শুধু বুড়িগঙ্গায় ২৫১ স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে পয়োবর্জ্য মিশছে বলে আরডিআরসির এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শিল্প-কারখানা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ক্লাস্টার ইটিপি রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, সব নিয়ম সঠিক মতো মেনে চলা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু সার্বক্ষণিক নজরদারি করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জনবল নেই।
হারিয়ে গেছে ৫২০ নদী: দেশে নদীর সংখ্যা জানতে আরডিআরসি একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ১৯৬৯ সালে ডিক্লাসিফাইড করোনা স্যাটেলাইট ইমেজ ও মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে জরিপ পরিচালনা করে ১ হাজার ২৭৪টি নদ-নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পায়। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৯ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসকদের নদীর সংখ্যা জানাতে চিঠি দেয়। নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২২ সালের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেশের নদ-নদীর তালিকা তৈরি করে আরডিআরসি। এতে সংস্থাটি ৭৫৪টি নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। সেখানে অনেক নদী একই নামে কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি জেলায় প্রবাহিত একই নদীকে একটি সংখ্যা ধরা হয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাউসার আহাম্মদ বলেন, সবাইকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। বেসরকারি পর্যায়েও নদী রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
কর্মসূচি: নদীকৃত্য দিবস উপলক্ষে সোমবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ও শেখ জামাল উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ। আজ সকাল ৯টায় মোহাম্মদপুরের বছিলায় মানববন্ধন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বছিলা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত নৌযাত্রার আয়োজন করেছে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ও জাতীয় নদী জোট।