যেদিন আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’, নামের অর্থ কী?

0
78
ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’
দক্ষিণপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা আগামী ২৬ মে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
 
বুধবার (২২ মে) আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক এসব তথ্য জানিয়েছেন।
 
তিনি জানান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা অঞ্চলের দিকে ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ রয়েছে। এর প্রতিনিয়ত গতিপথ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে; রাতে একটা গতিপথ থাকছে, আবার সকালে আরেকটা। তাই লঘুচাপ থেকে নিম্নচাপে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে তখন গতিপথ স্থির হবে। সেই সময় স্পষ্টভাবে বলা যাবে, এটা কোন এলাকায় বা স্থানে আঘাত হানতে পারে।
 
ওমর ফারুক জানান, ২২ মে লঘুচাপ তৈরি হয়ে ২৩ বা ২৪ মে-র মধ্যে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। ২৪ মে রাতে বা ২৫ মে সকালের দিকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
তখন এর নাম হবে ‘রেমাল’। এ নামটি ওমানের দেয়া। এটি একটি আরবি শব্দ। এই নামের অর্থ বালির কণা।
 
ঘূর্ণিঝড় পরিচিতি
 
ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন ও টাইফুন শুনতে তিনটি পৃথক ঝড়ের নাম মনে হলেও আসলে এগুলো অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়েরই ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড়কে ঘূর্ণিঝড় বা ট্রপিক্যাল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। ঘূর্ণিঝড় শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ থেকে, যার অর্থ বৃত্ত বা চাকা। এটা অনেক সময় সাপের বৃত্তাকার কুন্ডলী বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এ ধরণের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আটলান্টিক মহাসাগর এলাকা তথা আমেরিকার আশেপাশে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ যখন ঘন্টায় ১১৭ কিলোমিটারের বেশি হয়, তখন জনগণকে এর ভয়াবহতা বুঝাতে ‘হারিকেন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা তথা চীন, জাপানের আশে পাশে হারিকেন- এর পরিবর্তে ‘টাইফুন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
 
ঘূর্ণি ঝড় সৃষ্টির কারণ
 
আবহাওয়া গত নানা কারণে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য আনুষংগিক কিছু প্রভাবক নিম্নরূপ- (ক) সমুদ্রের তাপমাত্রা: (১) ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক এবং একটি নির্দিষ্ট গভীরতা (কমপক্ষে ৫০ মিটার) পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। এজন্য সাধারণত কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি সমুদ্রগুলোতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। অন্য কোথাও হয় না, (২) নিরক্ষরেখা থেকে দূরত্ব: নিরক্ষীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে গেলে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়। এ শূণ্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু উত্তর গোলার্ধে। দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট করিওলিস শক্তির কারণে এ বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এ জন্য আমরা দেখি, উত্তর গোলার্ধে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে। সাধারণত, নিরক্ষরেখার ১০ থেকে ৩০ ডিগ্রীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।
 
ঘূর্ণিঝড়ের শ্রেণি বিভাজন
 
বাতাসের তীব্রতা ও গতি বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে ৮টি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। শ্রেণিগুলো হলো: লঘুচাপ, সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং সুপার সাইক্লোন। বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৩১ কিলোমিটার বা এর নীচে হলে তাকে লঘুচাপ আখ্যায়িত করা হয়। এর গতি বাড়তে বাড়তে ঘন্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার হলে তাকে ঘূর্ণিঝড় এবং বাতাসের গতিবেগ ২২২ কিলোমিটার বা এর অধিক হলে সুপার সাইক্লোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী আদেশাবলির পরিশিষ্টে সমুদ্র ও নদী বন্দরসমূহের জন্য সংকেতসমূহ এবং দমকা হাওয়ার বেগ, সম্ভাব্য ফলাফল অথবা প্রভাব, বন্দরের জন্য হুঁশিয়ারি বার্তা এবং জনগণের জন্য বার্তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের শ্রেণি বিভাজন, সমুদ্র বন্দর এবং নদী বন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত এবং সংকেতসমূহের অর্থ বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
 
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ
 
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আঞ্চলিক কমিটি প্রতিটি ঝড়ের একটি নাম দিয়ে থাকে। ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে এ সংস্থার আটটি দেশ। দেশগুলো হল- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও ওমান। এ দেশগুলোর প্যানেলকে বলা হয় ডব্লিউএমও/এসক্যাপ (WMO/ESCAP)। অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে ঝড়ের নামকরণ করা হলেও, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঝড়ের নামকরণ শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে।
 
এক সময় ঝড়গুলোকে বিভিন্ন নম্বর দিয়ে শনাক্ত করা হতো। কিন্তু সেসব নম্বর সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। ফলে সেগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া, মানুষ বা নৌযানগুলোকে সতর্ক করাও কঠিন মনে হতো। নামবিহীন থাকলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, ধরন সম্পর্কে তথ্য দ্রুত জানা যায় না। এর আঘাত হানার সময় বা তারিখ বের করে পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হয় আবহাওয়াবিদদের। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ।
 
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের কাছ থেকে প্রাপ্ত নামের তালিকা থেকে সংস্থাটি নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করে। এবার ‘রেমাল’ নামটি প্রস্তাব করেছে ওমান। আরবিতে এর অর্থ বালি।
 
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় মিগযাউম, যা পরে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। সে ঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি। ২০২০ সালের মে মাসেই ২০ তারিখে দেশের উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বেশ বিধ্বংসী ছিল ঘূর্ণিঝড়টি। তবে সুন্দরবনের কারণে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল দেশের উপকূল। এর আগে ২০০৯ সালে এই মে মাসেই ২৫ তারিখে সুন্দরবনে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী আইলা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.