
যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত জীবনের আশায় জমি বিক্রি, ঘর বন্ধক রেখে এবং এজেন্টদের বিশ্বাস করে তাঁরা দেশ ছেড়েছিলেন। তাঁদের সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অবৈধভাবে বসবাস করা এসব ভারতীয় নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল রোববার ভোরে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৫০ তরুণকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এ সময় তাঁদের হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি ছিল।
ফেরত আসা এসব তরুণের অনেকের দাবি, অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপে ধরা পড়ার পর ঋণের বোঝায় ডুবে গেছেন তাঁরা।
হরিয়ানার কর্মকর্তাদের মতে, ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জন কারনালের, ১৪ জন কাইথালের, ৫ জন কুরুক্ষেত্রের ও ১ জন পানিপথের বাসিন্দা। তাঁরা সবাই দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মধ্য দিয়ে মানব পাচারের ‘ডানকি রুট’ হিসেবে পরিচিত পথ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ সেখানে কয়েক বছর ছিলেন, আবার কেউ মাত্র কয়েক মাস। ফেরত পাঠানোর আগে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে কারাভোগও করতে হয়েছিল।
ফেরত আসা ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ছিলেন কারনালের রাহরার অঙ্কুর সিং (২৬)। তিনি বলেন, ২০২২ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে তাঁর ২৯ লাখ রুপি খরচ হয়েছিল। ‘দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ’ হয়ে যেতে তাঁর এই যাত্রায় ‘প্রায় চার মাস’ লেগেছিল।
অঙ্কুর সিং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘আমি “ডানকি রুট” হয়ে গিয়েছিলাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে একটি মদের দোকানে কাজ করার সময় আমি ধরা পড়ি।’
অঙ্কুর বলেন, এরপর তাঁকে একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়। ২৪ অক্টোবর ভারতে ফেরার জন্য তাঁদের উড়োজাহাজে উঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের এই ফ্লাইটে হরিয়ানার প্রায় ৫০ জন ছাড়াও পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ, গুজরাট ও গোয়ার তরুণেরাও ছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৫০০ ভারতীয় নাগরিককে আটটি সামরিক, চার্টার্ড এবং বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফেরত পাঠানো বা প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং গুজরাটের মানুষ।
গতকাল রোববার ফেরত পাঠানো দলে ছিলেন কারনালের ঘোরাউন্দা ব্লকের পোপরা গ্রামের হুসন (২১)। তিন বোনের একমাত্র ভাই হুসন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন। তাঁর কাকা, সুরেন্দর সিং জানান, এজেন্টদের ৪৫ লাখ রুপি পরিশোধ করতে পরিবারকে তিন একর জমি বিক্রি করতে হয়েছিল।
সুরেন্দর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই হুসন ধরা পড়ে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা ছিল। তাঁরা রোববার রাত ১টার পর দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাঁদের হাতে হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি পরানো ছিল।’
কারনালের কালসী গ্রামের হরিশ এসসি (তফসিলি জাতি) শ্রমিক পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর ভাই রিঙ্কু বলেন, ‘তিনি ২০২৩ সালে কর্মীভিসায় কানাডায় গিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর সেখানে থাকার পর গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে একটি দোকানে কাজ শুরু করেন। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ধরা পড়েন।
কাইথালের তারাগড় গ্রামের নরেশ কুমার এক বছরের বেশি সময় আটক থাকার পর দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজে উঠানোর সময় আমাদের হাতকড়া পরানো হয়েছিল। তবে তাঁরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। ফেরত পাঠানোর আগে আমি সেখানে ১৪ মাস কারাগারে ছিলাম।’
নরেশ আরও বলেন, ‘আমি ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি দিল্লি থেকে রওনা হয়ে ব্রাজিল হয়ে ৬৬ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাই। আমাদের এজেন্টরা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা ৫৭ লাখ ৫০ হাজার রুপি নিয়েছিল। প্রথমে তারা ৪২ লাখ টাকায় পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে আরও টাকা চাইতে থাকে। আমি এক একরের বেশি জমি বিক্রি করেছি। সুদে ৬ লাখ টাকা ধার করেছি, আমার ভাই ৬ লাখ ৫০ হাজার রুপির জমি বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া আমাদের এক আত্মীয় আরও ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন।’
কাইথালের পুলিশ সুপার উপাসনা বলেন, ওই জেলার ১৪ জন ফেরত আসা ব্যক্তিকে রোববার বেলা ২টার দিকে দিল্লি থেকে নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা সবাই ‘ডানকি রুট’ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আবগারি মামলায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি ছিলেন। একাধিকবার আদালতের শুনানিতে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন।
জিণ্ডর এসপি কুলদীপ সিং নিশ্চিত করেছেন, তাঁর জেলা থেকে তিনজন ফেরত আসা ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদেরকে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এসপি সিং সতর্ক করে বলেন, ‘ডানকি রুটে’ বিদেশে যাওয়া গুরুতর অপরাধ। এটি পরিবারকে আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে এবং জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। পথে অনেকেই দুর্ব্যবহার, প্রতারণা, এমনকি মৃত্যুর মুখে পড়েন।
তথ্যসূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

















