সীমা অক্সিজেন প্লান্টের সীমা ছাড়ানো অনিয়ম

0
101

বিস্ফোরণে ছয় জীবন কেড়ে নেওয়া চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্লান্টের পায়ে পায়ে ছিল অনিয়ম। ওই প্লান্টে শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডারই ছিল না, অনুমোদন না থাকার পরও ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডারও। নিয়ম অনুযায়ী, এসব গ্যাস সিলিন্ডার আলাদা কক্ষে থাকার কথা। তবে প্লান্টে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা অক্সিজেনের পাশাপাশি একসঙ্গে পেয়েছেন কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডার। অনিয়মের এখানেই শেষ নয়, কারখানাটিতে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। হয়নি কখনও অগ্নিনির্বাপণ মহড়াও। লাইসেন্স আছে কিনা তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

এদিকে বিস্ফোরণে এক দিন পর ঘটনাস্থলে মালিক পক্ষের দেখা মিলেছে। তবে তাদের বক্তব্যও ছিল দায়সারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। মালিক পক্ষ ও তদারককারী সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘এটি কোনোভাবেই অবহেলায় মৃত্যু নয়। এটি হত্যাকাণ্ড। এর আগে বিএম ডিপোর ঘটনায় মালিকপক্ষকে আসামি না করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এবার যেন তা না হয়। প্লান্টটিতে বিভিন্ন গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার ছিল, তা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করার মতো প্রশিক্ষিত জনবল আছে কিনা তদন্ত কমিটিকে খতিয়ে দেখতে হবে।’

অনিয়মে ভরপুর: অগ্নিনিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, কারখানা স্থাপনের আগে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুমোদন নিতে হয়। সে অনুযায়ী, কারখানায় থাকার কথা ফায়ার স্টেশন, অগ্নিনির্বাপণের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ফায়ার হোজ রিল, পানির রিজার্ভার ও হোসপাইপ। তবে সীমা প্লান্টে এর কিছুই ছিল না। এ ছাড়া শ্রমবিধি অনুযায়ী, চার মাস পরপর অগ্নিনির্বাপণ মহড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তা কখনোই করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘এই প্লান্টে ফায়ার সার্ভিসের সেফটি প্ল্যান অনুমোদন নেই। তারা আবেদন করলেও পরিকল্পনার সব শর্ত পূরণ না করায় এখনও অনুমোদন পায়নি।’

শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে নিযুক্ত শ্রমিকের কমপক্ষে ১৮ শতাংশকে অগ্নিনির্বাপণ, জরুরি উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা এবং বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ৫০ বা তার বেশি শ্রমিক-কর্মচারী আছে এমন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার আয়োজনের নির্দেশনা রয়েছে। যা রেকর্ডবুকে সংরক্ষণ করতে হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁদের মধ্যে এমন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কাউকে পাওয়া যায়নি। কখনও আগুন নেভানোর মহড়াও তাঁরা দেখেননি।

সিলিন্ডার মজুতে মানা হয়নি নিয়ম : গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১ অনুযায়ী, সিলিন্ডার রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহারে বিধিনিষেধ, মজুত, রিফিল ও নড়াচড়ায় কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এর উল্লেখ রয়েছে। তবে প্লান্টটিতে এসব নিয়মের বালাই ছিল না। এসব দেখার দায়িত্ব বিস্ফোরক পরিদপ্তরের থাকলেও তারা সেটি দেখেনি। এ ছাড়া কারখানাটি কখন পরিদর্শন করেছেন তাও জানাতে পারেননি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কারখানাটিতে লাইসেন্স রয়েছে কিনা তাও বলতে পারেননি তাঁরা। গতকাল রোববার সকালে পরিদর্শনে যান বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ সময় অক্সিজেন ছাড়াও কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডারও দেখতে পান তাঁরা।

চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘প্রজ্বালনীয় গ্যাস ও বিষাক্ত গ্যাসের সিলিন্ডার অবশ্যই আলাদা করে রাখতে হবে। কোনো কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে অন্যান্য গ্যাস যুক্ত হয়ে বিস্ফোরণকে স্বাভাবিকভাবেই ভয়াবহ করে তোলে।’

চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘কারখানাটিতে লাইসেন্স রয়েছে কিনা জানা নেই। কারণ লাইসেন্স দেওয়া হয় বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয় থেকে।’

যে কারণে বিস্ফোরণ: বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে দুই প্রতিষ্ঠানের দুই মত পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিস মনে করছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলিন্ডার নয়, যেটির মাধ্যমে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা হয় সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, ‘বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। তদন্তে বিস্ফোরণের কারণ বেরিয়ে আসবে। ঘটনাস্থলে আমরা অনেক সিলিন্ডার দেখেছি। সিলিন্ডারগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয় না। প্রাথমিকভাবে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে ধারণা করছি।’ তবে রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে তা জানতে নিবিড় তদন্ত প্রয়োজন। তবে কারখানাটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটেনি। কারখানাটিতে চারটি পয়েন্টে সিলিন্ডার অক্সিজেন ভর্তি করা হয়। প্লান্ট থেকে যে কলামের মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডারে ভর্তি করা হয় সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে।

তদন্ত শুরু, মামলা করবে পুলিশ: বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। কমিটির সদস্যরা রোববার বৈঠক করে তাঁদের করণীয় নির্ধারণ করেছেন। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কমিটির সদস্যরা। এ সময় বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিনের সঙ্গে কথাও বলেছেন তাঁরা।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। হাসপাতালে গিয়ে বিস্ফোরণের সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা বলছি। বিস্ফোরণের কারণ উদ্ঘাটন, দায় কার, কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল কিনা এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে এর সুপারিশও করা হবে।’

এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলা আছে। নয় তো এত বড় ঘটনা ঘটত না। আমরা হতাহতদের নাম সংগ্রহ করছি। তাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করে মামলা করা হবে। প্রাথমিক তদন্তে মালিক পক্ষের গাফিলতি পেলে তাদেরও আসামি করা হবে।’

উদ্ধার অভিযান শেষ: এদিকে রোববার সকাল সাড়ে ৭টায় দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধার কাজ শুরু হয়। উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় বিকেল ৩টায়। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক মিয়া বলেন, ‘আমরা উদ্ধার অভিযান শেষ করে কারখানা এলাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এসেছি।  আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।’

পুলিশ পাহারায় এলো মালিকপক্ষ: বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল ৪টার দিকে পুলিশি পাহারায় ঘটনাস্থলে আসেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিন। এ সময় তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি অক্সিজেন উৎপাদন করে আসছে। কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। বিস্ফোরণ কেন ঘটল বুঝতে পারছি না।’ দেরিতে ঘটনাস্থলে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর আহত ও নিহত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ভবিষ্যতেও তাঁদের পাশে আছি। বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করেছি।’

তবে তাঁর এসব দাবির সত্যতা মেলেনি। ঘটনাস্থলে তদারককারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা গেলেও মালিকপক্ষের কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় অভিযোগ করেছিলেন।

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় কত শ্রমিক দুর্ঘটনার সময় কাজ করছিলেন, তার কোনো ধারণা আমরা পাইনি। তাঁদের অসহযোগিতার কারণে হতাহতদের খুঁজতে সিলিন্ডারগুলোও সরাতে বেগ পেতে হয়েছে।’

এদিকে বিস্ফোরণের ১৯ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে প্লান্টটির ব্যবস্থাপক আবদুল আলীম ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাড়াহুো করে ঘটনাস্থল ছাড়েন। তাঁর দাবি, প্রতিষ্ঠানটির ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সব সংস্থার ছাড়পত্র, সনদ রয়েছে। বিস্ফোরণে প্রতিষ্ঠানটির ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তাদের। কী কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

যেভাবে উত্থান সীমা গ্রুপের: চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘সীমা গ্রুপ’। এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড। গ্রুপটির ইস্পাত, জাহাজভাঙা ও অক্সিজেন কারখানা রয়েছে। বাণিজ্য গ্রুপটির কর্ণধার ছিলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানরা গ্রুপটির হাল ধরেন। ১৯৯১ সালে সীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙা কারখানার মধ্য দিয়ে সীমা গ্রুপের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু। ২০০৩ সালে সীমা অটোমেটিক রি-রোলিং মিলস স্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা হয়। শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদন করত সীমা অক্সিজেন লিমিটেড। জাহাজভাঙা কারখানা লোহারপাত ও ইস্পাত কারখানায় লোহার বিলেট কাটার কাজে ব্যবহৃত হয় এই গ্যাস। প্রতিষ্ঠানটিতে তিন শিফটে প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। দুর্ঘটনার সময় আহত ২৫ জনসহ মোট ৪২ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.