চলন্ত বাসে কতিপয় বিকৃত মস্তিস্কের মনুষ্য আদলের কাছে বর্বরতার শিকার হয়ে মেয়ে ওপারে চলে গেছে দু’বছর হলো। কিন্তু নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাণী আজও নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। জীবদ্দশায় মেয়ের হত্যাকারীদের শাস্তি দেখে যেতে পারবেন, সে আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেন রূপার মা হাসনাহেনা বেগম। বিচারের জন্য তাই এখন সৃষ্টিকর্তার দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।
টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে রোববার। রূপা সিরাজগঞ্জের তাড়াশের আসানবাড়ী গ্রামের মৃত জেলহক প্রামাণিকের মেয়ে।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার বিচার দুই বছরেও শেষ হয়নি। গত ১৯ মাস ধরে উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে রূপা হত্যা মামলার আপিল শুনানি। এ মামলায় ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল মনসুর মিয়া চার আসামির মৃত্যুদণ্ড ও একজনের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। এ ছাড়া ছোঁয়া পরিবহনের সেই বাসটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপার পরিবারকে দেওয়ারও আদেশ দেন আদালত।
আসামিদের মধ্যে ময়মনসিংহের ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর, হেলপার শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে মত্যুদণ্ড এবং সুপারভাইজার সফর আলীকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে ১ লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়।
মামলার বাদী রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান প্রামাণিক জানান, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করে। এরপর গত ১৯ মাসেও চাঞ্চল্যকর এ মামলায় শুনানি শুরু হয়নি।
তিনি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে দ্রুততম সময়ে মামলার রায় ঘোষণায় আমরা সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষের আপিলের পর মামলাটি গত দেড় বছর ঝুলে থাকায় হতাশ হয়েছি।’
হাফিজুর জানান, ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি রূপার পরিবারকে দেওয়ার যে আদেশ আদালত দিয়েছেন, তাও কার্যকর করা হয়নি। তিনি বলেন, বিচারের সর্বশেষ পর্যায়ে যেতে কতদিন সময় লাগবে, তা আমাদের জানা নেই। ততদিনে ওই বাসটি পেলেও হয়তো তা ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রি করতে হবে। এতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশাও ক্ষীণ।
রূপার মা হাসনাহেনার বয়স এখন ৫৭। মেয়ে চলে যাওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া স্মৃতি প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছে তাকে। কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না মেয়েকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাসনাহেনা বলেন, ‘আমরা আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছিলাম, নিম্ন আদালতে তা পেয়েও ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মামলাটি ঝুলে আছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অবসান চাই। দ্রুততম সময়ে আপিলের রায় হওয়ার পর আমার জীবদ্দশায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেখে যেতে চাই।’
রূপার ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রূপা হত্যার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। কবে বোন হত্যার বিচার পাব জানি না। তবে দেশে আর কোনো বোনের যেন এ রকম মর্মান্তিক মৃত্যু না হয় এবং অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কাজ না করে, সে জন্য দৃষ্টান্ত রাখতেই দ্রুততম সময়ে রূপা হত্যার বিচার শেষ হওয়া জরুরি।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে রূপাকে গণধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করে বাসের চালক-হেলপারসহ অন্য সহযোগীরা। এরপর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রূপার মরদেহ ফেলে যায় তারা।
ওই রাতেই মধুপুর থানা পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় নারী হিসেবে রূপার লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্তানে লাশ দাফন করা হয়। পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে ছোট বোন রূপার লাশ শনাক্ত করেন।
ঘটনার দু’দিন পর ২৮ আগস্ট ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কে চলাচলকারী ছোঁয়া পরিবহনের বাসের হেলপার শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর এবং চালক হাবিবুর ও সুপারভাইজার সফর আলীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা প্রত্যেকেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে আসামিরা নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে রয়েছে।