বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে বাংলা সংস্কৃতির উত্তরসূরিদের জন্য। এই দশকেই বাংলা চলচ্চিত্রের তিন মহারথী জন্মেছেন দুই বছর করে বিরতি নিয়ে। এই তিনজনের নাম একনিশ্বাসে উচ্চারিত হয় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে।
১৯২১ সালে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ২০২৩ সালে মৃণাল সেন আর ২০২৫ সালে ঋত্বিক ঘটক। তার মানে আর দুই বছর পর ঋত্বিকের জন্মশতবর্ষও চলে আসবে দেখতে দেখতেই। মেধা, উচ্চতা, বুদ্ধিবৃত্তি আর সৃজনশীলতায় একজন ব্যক্তিমানুষ কতটা সজীব, সক্রিয় আর তেজোদীপ্ত হলে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হয়—এই উপলব্ধিটুকুই শতবর্ষের মূল উপাদেয়। যথার্থ সৃজনশীল প্রাণ ফি বছর জন্মায় না, যুগে যুগে আসে।
সবাই-ই জানেন, মৃণাল সেন জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ১৭ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া, গণনাট্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ, এরপর আসেন চলচ্চিত্রে। প্রথমে নেপথ্যের শব্দকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন, তারপর চলচ্চিত্র নির্মাণে আসা।
প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাতভোর’। অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ আর মৃণাল সেনের ‘রাতভোর’ একই বছর কাছাকাছি সময়ে মুক্তি পেলেও ‘পথের পাঁচালী’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এই ছবিকে যতটা আলোয় এনেছিল সেই তুলনায় ‘রাতভোর’ অনেকটা আঁধারেই থেকে যায়।
এ সময় মৃণালও নিজেকে আলাদা করার জন্য অন্য পথ বেছে নেন। তাঁর চলচ্চিত্রে রাজনীতি আসে সরাসরি, মূল বিষয়বস্তু হিসেবে। অনেকে এই অনুযোগও করেছেন, রাজনীতি ও সামাজিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে প্রায় রোমান্টিকতার পর্যায়ে তিনি নিয়ে গেছেন কি না। তবু দর্শক হিসেবে তাঁর চলচ্চিত্রে আমরা সমাজভাবনার যে চিত্র দেখি, যে জীবনভাবনার খোরাক পাই, তা তুলনারহিত।
মৃণাল সেনের বেশির ভাগ কাজ সমকালীন সাহিত্য থেকে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি মুক্ত দুয়ার, নবীন-প্রবীণ সবার কাছ থেকেই নিয়েছেন। স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়ে শুরু। এরপর মহাদেবী ভার্মা, কানাই বসু, আশীষ বর্মণ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বনফুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুবোধ ঘোষ, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মুন্সী প্রেমচাঁদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলেন্দু চক্রবর্তীসহ আরও অনেকের কাছ থেকেই নিয়েছেন।
নিজে গল্প লিখলেও সেসব থেকে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরিতে খুব আগ্রহী ছিলেন না। নাকি নিজের গল্পের ওপর আস্থা ছিল না?—এ প্রশ্নটি কেউ জিজ্ঞেস করেছেন বলে জানা নেই। তবে নিজের ২০ নম্বর নির্মাণে একবার বেছে নিয়েছিলেন নিজের গল্প। ছবির নাম ‘চালচিত্র’। কিন্তু ছবিটা নির্মিত হলেও কোনো এক অজানা কারণে আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে তাঁর কোনো কষ্টবোধ ছিল বলেও কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায় না।
একই সময়ে চলচ্চিত্রের তিন মহারথী সমান দক্ষতা ও গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে গেলে কিছুটা তুলনা চলেই আসে। তবু সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিকের মধ্যে মিলের জায়গা যেটুকু ছিল, তা হলো বাণিজ্যচিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইতালিয়ান নিউ রিয়েলিজম, তথা নব্যবাস্তববাদের ধারায় বিশ্বাস রেখে স্বল্প বাজেটে সৃজনশীল ও আপসহীন নির্মাণ।
তবে তিনজনের মধ্যে মৃণাল সেনের কিছু বাড়তি যোগ আছে। তিনি বাংলা ও হিন্দি ছাড়া তেলেগু এবং ওড়িয়া ভাষায়ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করেছেন আলাদা ১২টি গল্প নিয়ে ১২ পর্বের ধারাবাহিক। মৃণাল সেনই একমাত্র নির্মাতা, যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনটি চলচ্চিত্র উৎসব—কান, বার্লিন ও ভেনিস উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
তিন চলচ্চিত্র নির্মাতার মধ্যে মৃণাল সেনই সবচেয়ে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং সংখ্যার দিক থেকেও তাঁর কাজের তালিকা সবচেয়ে দীর্ঘ।
‘মৃগয়া’ চলচ্চিত্রে প্রথমবার তাঁর সঙ্গে কাজ করেই মিঠুন চক্রবর্তী পেয়েছিলেন প্রথম জাতীয় পুরস্কার। জীবনঘনিষ্ঠ কাজের জন্য স্বীকৃত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রায় সব সর্বভারতীয় শিল্পীরাই তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন শাহ, ওম পুরি থেকে শুরু করে, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, নীনা গুপ্তা, দীপ্তি নাভাল থেকে হালের নন্দিতা দাস পর্যন্ত রয়েছেন।
তবু একটা প্রশ্ন রয়ে যায় সব সময়। তিন মহারথীর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশিবার বাংলাদেশে এসেছেন। ঋত্বিক ঘটক এখানে এসে নির্মাণ করেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সত্যজিৎ এখানে না এলেও এ দেশের শিল্পী ববিতাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘অশনিসংকেত’। কিন্তু মৃণাল সেনের কোনো ছবিতে বিষয় হিসেবে কোথাও যেমন বাংলাদেশ নেই, তেমনি বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর অংশগ্রহণও নেই।
কিন্তু তিনি ছিলেন ‘রাতভোর’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘আকাশ কুসুম’ আর ‘পুনশ্চ’তে। ছিলেন ‘মৃগয়া’য়, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কোলকাতা ৭১’ আর ‘পদাতিক’-এ। ক্যামেরা তাক করেছিলেন ‘আকালের সন্ধানে’। তৈরি করেছিলেন ‘ভুবন সোম’-এর পৃথিবী।
সৃজনশীল মানুষ আসলে অন্যের প্রত্যাশা অনুযায়ী পথ হাঁটতে পারেন না। তাঁরা পথ হাঁটেন মহাজগতের দূরপ্রান্তের দিকে চোখ রেখে। শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় নিজের গড়া চরিত্রে হয়তো নিজেই বাস করেন অনেকটা জুড়ে। কে জানে, চিত্রনাট্যের আড়ালে মৃণাল সেন নিজেই হয়তো ছিলেন ‘ভুবন সোম’ অথবা ‘পদাতিক’-এর বিপ্লবপ্রত্যাশী তরুণ।
প্রিয় নির্মাতা ও মহাত্মা মৃণাল সেনের শততম জন্মদিনে আমাদের বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি।