নতুন করে আবার সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তাতে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ঠিক করা হয়েছে ১৯৯ টাকা। সয়াবিন তেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মিলমালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চিনিকলের মালিকেরাও বেশি দামে বিদেশ থেকে চিনি আমদানির বিষয়ে সরকারের নিশ্চয়তা চেয়ে আবেদন করে। তবে চিনির দাম বাড়ানোর বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাজারে এখন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার ও মানভেদে রাজধানীতে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম সর্বনিম্ন ১৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৪৫ টাকা। সরকার খোলা চিনির দাম বেঁধে দিয়েছে প্রতি কেজি ১০৪ টাকা।
তেল-চিনির পাশাপাশি বাজারে দাম বেড়েছে ডিম, পেঁয়াজ, রসুন ও আদার। অন্যান্য নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল, আটা ও ডাল বাড়তি দামে স্থিতিশীল রয়েছে।
ব্যবসায়ী ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের সর্বশেষ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ১৫ ডিসেম্বর। ওই সময় বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে ১৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর গত বুধবার প্রতি লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে দাম বাড়ানোর এ ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এর আগে কয়েক দিন ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহে কিছুটা সংকট দেখা দেয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী তেল পাচ্ছিলেন না। এ অবস্থায় বুধবার তেল ও চিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ওই বৈঠকের পর দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাজারে সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের দাম প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ২০৫ টাকায় উঠেছিল গত জুনে। এরপর কয়েক দফায় দাম সমন্বয়ের ফলে এ দাম কমে গত অক্টোবরে ১৭৮ টাকায় নামলেও এখন আবার তা ১৯৯ টাকায় উঠেছে।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৫৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৬০ টাকা। এত দিন এ দাম ছিল ৯০৬ টাকা। এ ছাড়া খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে ১৭৬ টাকা করা হয়েছে। এত দিন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ছিল ১৬৭ টাকা। সয়াবিনের পাশাপাশি বেড়েছে পাম তেলের দামও। প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম ১৮ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩৫ টাকা।
ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা তুলে নেওয়ায় দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল হ্রাসকৃত ভ্যাট–সুবিধা তুলে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। এরপর পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
এদিকে গতকাল সকালে দাম বাড়ানোর বিষয়টি জানাজানি হলেও রাজধানীর পাঁচ বাজারে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পুরোনো দাম তথা ১৮৭ টাকায় বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে।
চিনির সংকট প্রকট
সয়াবিনের দাম বাড়ানোর পর বাজারে সরবরাহ বাড়লেও চিনির সংকট যেন কাটছেই না। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পলাশী, নিউমার্কেট, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান ও তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজারের ২৭টি দোকান ঘুরে ১৪টিতেই চিনি পাওয়া যায়নি। বাকি ১৩টি দোকানে চিনি পাওয়া গেলেও তা ছিল খোলা চিনি। ২৭ দোকানের কোনোটিতেই প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যায়নি। এসব দোকানে প্রতি কেজি খোলা চিনি সর্বনিম্ন ১৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। অথচ সরকার খোলা চিনির দাম বেঁধে দিয়েছে প্রতি কেজি ১০৪ টাকা। গত সেপ্টেম্বর থেকে সরকার পাঁচবার চিনির দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তা কার্যকর হয়নি।
তেল ও চিনির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক এস এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নতুন দামের সয়াবিন তেল দ্রুত বাজারে আসবে। তবে এখনো আমরা পুরোনো দামের তেল বাজারে ছাড়ছি। আমাদের কাছে এখনো দুই দিনের তেল মজুত আছে। তবে চিনির দামের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা দরকার। তা না হলে মিলমালিকেরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।’
রাজধানীর পলাশী বাজারের রাসেল স্টোরের মালিক মো. হাবিব বলেন, ‘আশা করছি, দাম বাড়ানোর ফলে এখন সয়াবিন তেলের জোগানে কোনো সমস্যা হবে না। তবে চিনির সংকট চলছে অনেক দিন ধরেই। সেই সংকট এখনো মিটছে না।’
তেল-চিনির দাম বাড়ছে যে কারণে
সাধারণত বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়ে সয়াবিনের দাম। তবে এখন বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম কমলেও দেশে দাম বেড়েছে। সেটি হয়েছে মূলত ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা তুলে নেওয়ায়।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তি। দেশেও আসতে শুরু করেছে বাড়তি দামের চিনি। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় চিনির আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকেরা। গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানু-এপ্রিল) চিনির আমদানি ৩০ শতাংশ কমেছে। আবার পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসের আমদানি সবচেয়ে কম। আমদানি কম হওয়ায় বাজারে চিনির সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
নিত্যপণ্যের বাজারে যে অবস্থা
বাজারে গত সপ্তাহের তুলনায় ডিমের দাম বেড়েছে। রাজধানীর নিউমার্কেট ও পলাশী বাজারে ব্রয়লার মুরগির বাদামি রঙের প্রতি ডজন ডিম ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। আর সাদা রঙের ডিমের ডজন ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। গত সপ্তাহের চেয়ে ডজনপ্রতি দাম ১০ টাকা বেড়েছে। আর দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিমের ডজন ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হয়।
এদিকে ব্রয়লার মুরগির দাম গত সপ্তাহের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা কমেছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ২১৫ থেকে ২২০ টাকা। আগের সপ্তাহে এ দাম উঠেছিল ২৪০ টাকায়। আর সোনালি মুরগি আগের সপ্তাহের মতো ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে বাজারে ঈদের আগে বেড়ে যাওয়া গরু-খাসির মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা এবং খাসির মাংস ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়।
বাজারে চাল, আটা ও ডালের দামেও বড় কোনো পরিবর্তন নেই। দু-একটি সবজি বাদে অধিকাংশ সবজির দামে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। বেশির ভাগ সবজির দাম কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। তবে আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা।
এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
এক মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো। টিসিবির হিসাবে, প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে দেশি রসুনের দাম ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। আর আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা গৃহিণী আমিরুন নাহার বলেন, ‘রোজার পরে পণ্যের দাম কমে আসার কথা। কিন্তু আজকে (গতকাল) দেখলাম তেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নতুন করে বাড়ল। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত।’