পুলিশের মাদকের অভিযানে উদ্ধার ১৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা গায়েব

0
149
জব্দ কৃত টাকা

ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি সাদ্দাম। তাঁর ঘরের তালা ভেঙে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও ৫০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে পুলিশ। সাদ্দামকে না পেয়ে তাঁর ভাই আকাশ ও বাবা মো. আকবরকে থানায় নেওয়া হয়। পরে আকাশসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এজাহারে বলা হয়, মাত্র ৫ হাজার টাকা ও ৫০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ এজাহারে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধারের তথ্য গোপন করে আত্মসাৎ করা হয়। মামলায় তিনজনকে আসামি করা হলেও সাদ্দামের নাম নেই।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে চালানো গত ১২ এপ্রিল ভোরের এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) তারেক জাহান খান। সেখান থেকে লাল পলিথিনের ব্যাগে করে টাকা নিয়ে আসেন কনস্টেবল জুয়েল ভূঁইয়া।

পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তে এমন তথ্য উঠে আসার পর তারেক জাহানকে তিন দফা বদলি করা হয়েছে। প্রথমে তাঁকে মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ি থেকে শেরেবাংলা নগর থানায় বদলি করা হয়। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং সর্বশেষ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে।

তারেক জাহানের মাদকের টাকা আত্মসাৎ এবং ভুয়া অভিযানের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন পুলিশের মোহাম্মদপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আজিজুল হক। তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনা তাঁর জানা নেই।
মাদকের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাটি জানাজানি হয় অনেক পরে। তবে সবাই জানেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় কেউ এ নিয়ে কথা বলতে চান না।

টাকা আত্মসাত করতে সাজানো মামলা

অনুসন্ধানে দেখা যায়, অভিযানের পর পুলিশ যে মামলা করে, সেটি সাজানো। মামলার একজন সাক্ষী ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। অন্যজন ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে এজাহারের বর্ণনার কোনো মিল নেই।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার আকাশের শয়ন কক্ষের তোশকের নিচ থেকে ৫০০ গ্রাম হেরোইন এবং মাদক বিক্রির ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় আকাশের দুই সহযোগী গোলাম কসাই ও জাহিদ নামে দুজন পালিয়ে যান। হেরোইন ও ৫ হাজার টাকা সাক্ষীদের সামনে জব্দ করা হয়।

তবে মামলার সাক্ষী মোয়াজ্জেম হোসেন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ভোরে পুলিশ সাদ্দামের ঘরে গিয়ে তালা দেখতে পায়। পুলিশের সোর্স সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে সাদ্দামের ঘরের তালা ভেঙে ব্যাগভর্তি টাকা ও হেরোইন উদ্ধার করে। তবে কত টাকা এবং কী পরিমাণ হেরোইন উদ্ধার হয়েছিল, তা তাঁর সামনে গোনা হয়নি। পুলিশ যখন যায়, আকাশ তখন দোতলায় ঘুমাচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁকে ডেকে তুলে সাদ্দামের ঘরের তালা ভাঙে। পুলিশ তাঁকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেছিল। সেখানে তিনি স্বাক্ষর করেছেন।

এই মামলার এজাহারে তালা ভাঙার কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে পুলিশের সোর্স সোহেল বলেন, এসআই তারেক জাহান তাকে মুঠোফোনে ডেকে এনে তালা ভাঙতে বলেছিলেন। তবে কার কক্ষের তালা ভেঙেছেন, সেটি তিনি জানেন না। তিনি তালা ভেঙেই চলে যান।

এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আনোয়ার হোসেন ওরফে কাল্লু নামে একজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মাদকের মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তাঁর ৬ মাসের সাজা হয়েছিল। আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার সময় জেনেভা ক্যাম্পের ফটকে তারেক জাহানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তখন তাঁকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। তিনি শুধু স্বাক্ষর করেছেন। কেন তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না বলেও জানান।

বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে মাদক ব্যবসায়ী সাদ্দামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁর ঘরে মাদক বিক্রির ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা রাখা ছিল। যার কাছ থেকে মাদক নেন, তাঁকে দেওয়ার কথা ছিল। যখন তাঁর ঘরে অভিযান চলে তিনি বাসায় ছিলেন না। তিনি দাবি করেন, তাঁর ভাই আকাশ ও তাঁর বাবা আকবর মাদক ব্যবসায় জড়িত নন। তাঁর ভাই মাছ বিক্রি করে সংসার চালান। আর বাবা এখনো রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তাঁদের নামে এর আগে কখনো মামলাও নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই তারেক জাহান খান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের বিরুদ্ধে বড় বড় অভিযান চালানোর কারণে সেখানে তাঁর অনেক বিরোধী পক্ষ তৈরি হয়েছে। তারাই এসব কথা বলছেন। ঘটনাস্থলে যা পাওয়া গেছে, যেভাবে আসামি ধরা হয়েছে, মামলাও সেভাবেই হয়েছে। তিনি দাবি করেন, টাকার কথা বলছেন মাদক ব্যবসায়ীর লোকজন। যে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে, সেটিই এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় কোনো ভুয়া সাক্ষী করা হয়নি।

অন্য মামলার সাক্ষীও মাদক কারবারিরা

এসআই তারেক জাহানের বিরুদ্ধে জেনেভা ক্যাম্পে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্রের তথ্য মতে, তাঁর গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অর্থ সংগ্রহ করতেন কনস্টেবল জুয়েল ভূঁইয়া। এই গ্রেপ্তার বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারিক জাহানের সোর্স মো. কলিম ওরফে জাম্বু, আনোয়ার হোসেন ওরফে কালু ও সোহেল। তারেক জাহান যেসব মামলা করতেন ঘুরেফিরে এই ব্যক্তিদেরই সাক্ষী করা হত। তারেক জাহানের দায়ের করা দুটি মামলায় আনোয়ার, একটি মামলায় সোহেল এবং একটি মামলায় কলিম জাম্বু ও সোহেলকে সাক্ষী করা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী সাদ্দামের বাসা থেকে টাকা উদ্ধারের পর সাজানো মামলায় গোলাম কসাই ও জাহিদকে আসামি করা হয় কলিম জাম্বুর যোগসাজশে। তাঁদের দুজনের সঙ্গে কলিম জাম্বুর ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এসব তথ্য উঠে এসেছে।

১৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায় এসআই তারেক জাহানের সঙ্গে মোহাম্মদপুর থানার একজন পরিদর্শকের যোগসাজশ ছিল বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর কনস্টেবল জুয়েলকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় বদলি করা হয়েছে।

কনস্টেবল জুয়েল বলেন, তিনি তারেক জাহানের মুন্সি ছিলেন। এ কারণে তারেক জাহানের কোনো বিষয় এলেই তাঁর নাম আসে।

তবে যে অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, তার কথাই মনে করতে পারছেন না বলে দাবি করেন জুয়েল ভূঁইয়া। তিনি কোনো গ্রেপ্তার বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন না বলেও দাবি করেন।

মোহাম্মদপুরের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তারেক জাহানকে মোহাম্মদপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ করা হয়েছিল পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে। তারেক জাহান সরাসরি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এ কারণে কেউ তাঁকে কিছু বলতেন না। এই সুযোগে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.