মাহবুব তালুকদারের চোখে কেমন ছিল, ২০১৮ সালের পাঁচ সিটি নির্বাচন

0
119
মাহবুব তালুকদার

সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ছিল অনিয়মের নানা অভিযোগ। বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তখন বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অবশ্য সে সময় কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বরাবরই দাবি করেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন ওই কমিশনের সদস্য নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত মাহবুব তালুকদার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও  ভিন্নমতের কথা তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ‘নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো’ বইয়ে।

২০১৮ সালের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দৃশ্যত ওই নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে নির্বাচন নিয়ে কারচুপি, দলীয় এজেন্টকে ঢুকতে না দেওয়া, জাল ভোট দেওয়া, কেন্দ্র দখল, দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও সরকারদলীয় ব্যক্তিদের হুমকির অভিযোগ করেছিল বিএনপি। নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছিল বলে নিজেদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছিল নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)।‘

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদারকে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তিনি কয়েকটি কেন্দ্রের ভোটের হার বিশ্লেষণ, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ওই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ওই নির্বাচনের ‘স্বরূপ সন্ধান’ করেছিলেন। তবে ইসি সে প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।

‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৮: স্বরূপ সন্ধান’ শিরোনামে একটি অধ্যায় আছে মাহবুব তালুকদারের বইয়ে। প্রয়াত মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার থাকার সময় এই বই লিখেছেন। তবে তখন তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বই প্রকাশ করা হবে এবং সে জন্য এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে রেখে যাচ্ছেন।

তাঁর মৃত্যুর পরই বইটি প্রকাশ করা হয়। নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের ভিন্নমত সে সময় গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হতো। পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন কীভাবে দেখেছিলেন, তা মাহবুব তালুকদার নিজের বয়ানে তুলে ধরেছেন তাঁর বইয়ে।

‘গাজীপুর নির্বাচন শুদ্ধ হয়নি’

গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদার তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার মতে গাজীপুরের নির্বাচন শুদ্ধ হয়েছে এসব কথা বলা যায় না। দৃশ্যমান বা অদৃশ্য যা-ই বলা হোক না কেন, এই নির্বাচন প্রশাসন ও পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এহেন নির্বাচন আইনানুগ হয়েছে বলেও আমি মনে করি না। কারণ, আইন এখানে নিজস্ব গতিতে চলার সুযোগ পায়নি।’

মাহবুব তালুকদার ওই নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে লিখেছেন এভাবে, ‘নির্বাচনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, শিডিউল ঘোষণার পর তারা কার অধীন? নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তারা আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে কমিশনকে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। কিন্তু নির্বাচনকালে তারা কোনো যোগাযোগই করেন না।’

ওই নির্বাচনে ভোটের মাঠে বড় কোনো সংঘর্ষ বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এই বিষয়ে মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, ‘এ কথা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ নেই যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো খুনখারাবি, হাতাহাতি, মারামারি পর্যন্ত হয়নি। আহত-নিহতের কোনো ঘটনা ছিল না। শান্তিপূর্ণ অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র পরিমাপক নয়।…গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া ও অবাঞ্ছিতভাবে কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট দেওয়ার ঘটনাগুলো ঘটার পরেও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছ থেকে এসব বিষয়ে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায় না।

বিশেষত, প্রতিটি কেন্দ্রে পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তাদের সম্মুখে দৃষ্টিগ্রাহ্য অনিয়ম হতে পারে, তা বোধগম্য নয়।’ মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, ‘গাজীপুর নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করা কঠিন। তবে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা বিরোধী দলের নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা সর্বক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না। পুলিশ সুপারের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।’

বিষয়টি উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘দীর্ঘকাল যাবৎ একই স্থানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সুপারকে বদলি করা হলে নির্বাচন অনেক বেশি সুষ্ঠু হতে পারে বলে রিটার্নিং অফিসারও অভিমত প্রকাশ করেছেন। পুলিশ সুপারের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। অথচ সর্বদা বলা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।’

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের স্বরূপ সন্ধানে নেমে মাহবুব তালুকদার কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে যেখানে ভোটের হার ৮৫-৯৫ শতাংশ ছিল, এত ভোট পড়ার কারণ বের করার চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি ১৩৩ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরেন। সেটি এ রকম, ‘কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার অভিযোগ করেন যে স্থানীয় থানার ওসি নির্বাচনের আগের রাত ৩টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠিয়ে ২০ শতাংশ ভোট নৌকায় দিয়ে রাখার জন্য বলেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার একটি থানার ওসি ও একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হয়ে “সহযোগিতা” করতে বলেন।’

গাজীপুর সিটির নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। মাহবুব তালুকদারের ভাষায়, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনে কোনো পক্ষে প্রভাব বিস্তার করা নিষিদ্ধ হলেও গাজীপুরে সে বিধি প্রয়োগের কোনো লক্ষণ ছিল না। নির্বাচনে আইন বা কার্যক্রমের যেসব ফাঁকফোকর থাকে, তা নিরসনে নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট তৎপরতা ছিল। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ খুব একটা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।’

‘বরিশালের নির্বাচন বন্ধ করার প্রস্তাব ছিল’
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাসখানেক পর ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছিল বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ তিনটি নির্বাচন দেখভালের জন্য তিনজন নির্বাচন কমিশনারকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মাহবুব তালুকদারের দায়িত্বে ছিল বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। অনিয়মের চিত্র দেখে তিনি ভোটের দিন মাঝপথে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

মাহবুব তালুকদার তাঁর বইয়ে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘বরিশালের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদারের সঙ্গে আমি কথা বলে ধারণা পাই, বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমার অভিমতের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে অন্যান্য কমিশনার একমত হন। কিন্তু কোন আইনে আমরা নির্বাচন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারি, তা জানার জন্য যুগ্ম সচিব (আইন) সেলিমকে ডাকা হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.