মালয়েশিয়ায় জন্মদিন, পরীমনি লিখলেন, ‘বাঁচা জীবন উদ্‌যাপন করাই শ্রেয়’

0
18
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পোস্টে রিঅ্যাকশন ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, মন্তব্য পড়ে সাড়ে চার হাজারের বেশি, ফেসবুক থেকে

চিত্রনায়িকা পরীমনির জন্মদিন মানেই একসময় ছিল জমকালো আয়োজনের প্রতীক। বছরের পর বছর পাঁচতারা হোটেলের আলোকছটা, সহকর্মীদের কোলাহল, থিম ধরে রঙিন গাউন, কেক কাটায় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ—সব মিলিয়ে ঢাকাই শোবিজ অঙ্গনের এক অনিবার্য উৎসব হয়ে উঠেছিল তাঁর জন্মদিন। সেই ঝলমলে জন্মদিনগুলো এখন যেন অতীতের গল্প। সময় বদলেছে, পরীমনিও বদলেছেন। এবারের জন্মদিনে (২৪ অক্টোবর) তিনি নেই দেশে, নেই আয়োজনের আড়ম্বরও।

একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে, দূর দেশে কাটছে তাঁর জন্মদিন—মালয়েশিয়ার এক নিরিবিলি শহরে। কয়েক দিন আগে নিজের ফেসবুকে আগাম কেক কাটার ছবি পোস্ট করেছিলেন পরীমনি। ক্যাপশনে জানালেন, ‘দেশ ছাড়ছি দশ দিনের জন্য। গন্তব্য মালয়েশিয়া।’ আর জন্মদিনের দিন শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সেখান থেকেই লিখলেন সেই আত্মবিশ্বাসী সুরে—‘এ জীবন শুধু বেঁচে থাকার চেয়ে বাঁচা জীবন উদ্‌যাপন করাই শ্রেয়। জীবনের আনন্দ, বেদনা, কষ্ট, সুখ—সবকিছু নিয়েই আজকের এই জীবন।’ পোস্টের শেষে লিখলেন—‘হ্যাপি বার্থডে মাইসেলফ!’ মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পোস্টে রিঅ্যাকশন ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, মন্তব্য পড়ে সাড়ে চার হাজারের বেশি। যা প্রমাণ করে—ভক্তদের আগ্রহ একটুও কমেনি। আলো হয়তো বদলে গেছে, কিন্তু নিভে যায়নি।

‘ভালোবাসা সীমাহীন’ থেকে ‘মা’
এ কথাটা বারবার বলা হয়েছে, পরীমনির জীবনের গল্প একেবারেই সিনেমার মতো। ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর পরীমনির জন্ম হয়েছিল সাতক্ষীরায়। তবে তিনি বড় হয়েছেন পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে। চলচ্চিত্রজগতে তিনি পরীমনি নামে পরিচিত হলেও তাঁর জন্মনাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন সালমা সুলতানা। সে সময় মা–হারা পরীমনিকে বাবা মনিরুল ইসলাম রেখে আসেন তাঁর নানাবাড়ি পিরোজপুরে। সেখানে নানা শামসুল হক গাজীর তত্ত্বাবধানে ছোটবেলা কাটে অভিনেত্রীর। ২০২৩ সালে সেই নানাকেও হারিয়েছেন। বার্ধক্যের কারণে নানার মৃত্যু হয়।

নানা শামসুল হক গাজীর কোলে পরীমনির সন্তান রাজ্য, পাশে মা পরীমনি
নানা শামসুল হক গাজীর কোলে পরীমনির সন্তান রাজ্য, পাশে মা পরীমনি, ছবি : ফেসবুক

নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে (বাফা) নাচ শিখতে ভর্তি হন পরী। নাচ করতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এভাবে সুযোগ পান টিভি নাটকে অভিনয়ের। ‘সেকেন্ড ইনিংস’, ‘এক্সক্লুসিভ’, ‘এক্সট্রা ব্যাচেলর’ নামের নাটকে দেখা গেছে তাঁকে। এরপর ‘নারী ও নবনীতা তোমার জন্য’ নামের একটি নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। ২০১৫ সালে সিনেমায় নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় পরীর। ওই সময় নজরুল ইসলাম খানের পরিচালনায় ‘রানা প্লাজা’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেন পরী। কিন্তু ছবিটির মুক্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর প্রযোজক হয়ে শাহ আলম মণ্ডলের পরিচালনায় নির্মাণ করেন ‘ভালোবাসা সীমাহীন’ নামের একটি ছবি। এটিই পরীর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি। রোমান্টিক চরিত্রে সহজ–সাবলীল অভিনয়ে নজর কাড়েন নতুন এই মুখ। সে সময় একসঙ্গে দুই ডজনের মতো সিনেমায় চুক্তি করে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চুক্তিবদ্ধ হওয়া অধিকাংশ সিনেমাই নির্মিত হয়নি। কয়েকটি আবার নির্মাণের পর মুক্তির আলো দেখেনি। পরের বছর ‘রূপবান’-এ গ্রামীণ মাটির মেয়ে হয়ে তিনি জানান দেন গ্ল্যামারের বাইরেও তাঁর ভেতরে আছে এক অন্তরঙ্গ সংবেদনশীল অভিনেত্রী। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের স্বপ্নজাল-এ রূপার চরিত্রে পরীমনি ছিলেন একদম অন্য রকম। সীমান্তঘেরা দুই জীবনের ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষার ভেতরে তিনি ছিলেন নরম অথচ দৃঢ়।

গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত সেই সিনেমায় ‘শুভ্রা’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় প্রমাণ দেয় পরীকে জানতে–বুঝতে পারে, এমন একজন অভিজ্ঞ পরিচালকের হাতের পুতুল হলে পরী নিজেকে প্রমাণ দিতে সক্ষম।

‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করেছেন পরীমনি।
‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করেছেন পরীমনি। ছবি: সংগৃহীত

‘বিশ্বসুন্দরী’-তে পরীমনি আবারও ভিন্ন ছায়া ছুঁয়েছেন। তাঁর চরিত্র তৃষ্ণা-ভালোবাসার পিপাসায় পুড়তে থাকা এক নারী, যার চোখে অজানা বিষণ্নতা আর মুখে অব্যক্ত প্রত্যয়। এই ছবিতে প্রেমের যে সৌন্দর্য তিনি ফুটিয়েছেন, তা তাঁকে এনে দিয়েছে দর্শকের বিশেষ ভালোবাসা। আর ‘গুণিন’-এ তিনি যেন বাস্তব ও কল্পনার মধ্যবর্তী এক সত্তা। একদিকে রহস্যে মোড়া, অন্যদিকে সম্পর্কের সংঘাতে জর্জর এক নারী—যার চাওয়া, ভালোবাসা ও ক্ষত একাকার। ‘গুণিন’-এ তাঁর চোখের ভাষা, শরীরের নীরবতা—সবই প্রমাণ করেছে তিনি নিজেকে চরিত্রে ঢেলে দিতে জানেন। অন্যদিকে তাঁর অভিনয়জীবনের সবচেয়ে আরেক ব্যতিক্রম চরিত্র ছিল ‘মা’ ছবিতে।
সন্তান হারানো এক মায়ের চরিত্রে পরীমনি রূপান্তরিত হন আবেগের প্রতিমূর্তিতে। এই ছবিতে গ্ল্যামার নেই, আছে যন্ত্রণা, মাতৃত্ব, সংগ্রাম, যা তাঁর অভিনয়জীবনের এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।

এক সাক্ষাৎকারে পরীমনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, তা আমাকে থামায়নি। বরং এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে। আমি ভাঙি, আবার নিজেকে গড়ি।’ এই বাক্যটাই যেন তাঁর শিল্পীসত্তার আত্মপ্রতিকৃতি।
বিতর্ক, প্রতিবাদ আর ভালোবাসার নাম পরীমনি
বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কম নায়িকা আছেন, যাঁরা ব্যক্তিজীবনকে এত খোলামেলা ভাগ করেছেন। ভালোবাসা, বিয়ে, বিচ্ছেদ, মাতৃত্ব—সবকিছুই পরীমনি করেছেন অকপটে। কখনো সেই খোলামেলাটাই তাঁকে টেনে এনেছে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, আবার কখনো বানিয়েছে প্রতিবাদের প্রতীক। রুপালি পর্দার বাইরে বাস্তব জীবনের এক ফাইটার পরীমনি—যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন, নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন, আর প্রয়োজনে ভুল স্বীকার করতেও ভয় পান না। আইনি ঝামেলা, মিডিয়ার সমালোচনা, সামাজিক কটাক্ষ—সব পেরিয়েও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন আরও শক্ত হয়ে। যেন আগুনে পুড়ে আরও দীপ্ত হয়েছে তাঁর আলো।

প্রেম, ভালোবাসা ও বিয়ে
পরীমনির জীবনের প্রেমকাহিনি নিয়েও জনমাধ্যমে আলোচনার শেষ নেই। এ বিষয়ে তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে হেসে বলেছিলেন, ‘আমার না আসলে ১২টা বিয়ে করার ইচ্ছা আছে। ছোটবেলা থেকে বলতাম, আমি এক ডজন বিয়ে করব। কিন্তু রিউমারটা এত জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে এখন মনে হয় বলা ভুল ছিল।’ কৈশোর পার করেই নাকি তাঁর প্রথম বিয়ে, যা টেকেনি খুব বেশি দিন। ২০১২ সালে পরিচালক কামরুজ্জামান রনির সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের খবরও শোনা যায়। পরে তাঁদের পথ আলাদা হয়ে যায়। এরপর ‘গুণিন’ সিনেমার শুটিংয়ে পরিচয় শরীফুল রাজের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রণয়, প্রণয় থেকে সংসার। সেই সংসারে আসে তাঁদের ছেলে রাজ্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সম্পর্কের সমীকরণ। বিচ্ছেদ আসে নীরবে, কিন্তু রাজ্য থাকে দুজনেরই কেন্দ্রবিন্দুতে। আজও সন্তানের কারণে পরীমনি ও রাজের দেখা হয় মাঝেমধ্যে, তবে তাঁদের জীবন এখন দুটো ভিন্ন স্রোতে বয়ে চলেছে।

পরীমনি
পরীমনিফাইল ছবি

জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়
২০২২ সালে ছেলে রাজ্যর জন্ম পরীমনির জীবনে এনেছে নতুন আলো। এখন তিনি শুধু তারকা নন, একজন মা। রাজ্যকে ঘিরে তাঁর পৃথিবী এখন ছোট অথচ পূর্ণ। ফেসবুকে প্রায়ই দেখা যায় রাজ্যর সঙ্গে তাঁর মুহূর্তগুলো—কখনো বই পড়ছেন, কখনো ছেলেকে আঁকা শেখাচ্ছেন, আবার কখনো লিখছেন এক লাইনে—‘আমার সব আনন্দ এই চোখ দুটোতে।’ সমালোচকদের মতে, এই মা–পরীমনিই আসল পরীমনি, যিনি যত বিতর্কেই থাকুন, সন্তানের হাসির মধ্যেই খুঁজে পান জীবনের মানে। বর্তমানে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে দুই সন্তানকে নিয়ে দারুণ সময় কাটাচ্ছেন পরী।

গুজব, প্রতিক্রিয়া ও দৃঢ়তা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সার্চ দিলে পরীর কান্নার অনেক ভিডিও পাওয়া যাবে। আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছেন। কেঁদেছেন সংবাদ সম্মেলনে। এক জীবনে অনেকবার কেঁদেছেন পরী। দুঃখে কেঁদেছেন, সুখে কেঁদেছেন। তবে পরীর কান্নার লোনাজলে যেন হাসিটাই লুকিয়ে থাকে। ফেসবুকজুড়ে পরীর হাসিমুখের জয়জয়কার।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে চাঞ্চল্যকর গুজব—‘নায়িকা পরীমনি মারা গেছেন।’ সেই গুজবের জবাব দিতে একদম নিজের ঢঙে ফেসবুক লাইভে আসেন তিনি। সেখানে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি সুইসাইড করার মতো মেয়ে না। আমার জীবনে এখন সুইসাইড করার মতো কোনো ইস্যুই নাই। আমার বাচ্চা নিয়ে, কাজ নিয়ে আমি অনেক খুশি। কিছু হইলে খালি পরীমনিকে নিয়ে টানাটানি কেন? অন্য কিছু খুঁজে পান না নাকি?’ এই আত্মরক্ষার হাসিতেই লুকিয়ে আছে তাঁর মানসিক দৃঢ়তা। সমালোচনা তাঁকে দমাতে পারেনি; বরং প্রতিটি আঘাতই যেন তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছে যেন।

পরীমনি
পরীমনিশিল্পীর সৌজন্যে

শিল্পী, মানুষ, আর অনমনীয় সত্তা
২০২১ সালের আগস্টে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পরী। নেওয়া হয়েছিল রিমান্ডেও। পরের মাস সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কারাগার থেকে বাসায় ফিরে দেখলেন, সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালকেরা তাঁর বাসায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন! একসময় ফোর্বসের ১০০ ডিজিটাল তারকা তালিকায়ও ছিল পরীর নাম।
গ্ল্যামার বা খবরের বাইরে পরীমনি একজন শিল্পমনস্ক মানুষ। বই পড়েন অবসরে। গান শোনেন। তাঁর পোশাক ভাবনা প্রশংসা পায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একদিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটা সিনেমার মতো, কিন্তু আমি এখনো নিজের স্ক্রিপ্ট লিখছি।’ এই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে আলাদা করে। যেখানে অনেকেই চুপ করে থাকেন, পরীমনি সেখানে নিজের মতামত রাখেন নির্ভয়ে।

জন্মদিনে, পরীমনি লিখলেন, ‘বাঁচা জীবন উদ্‌যাপন করাই শ্রেয়’
জন্মদিনে, পরীমনি লিখলেন, ‘বাঁচা জীবন উদ্‌যাপন করাই শ্রেয়’ফেসবুক থেকে

আজ তাঁর জন্মদিন। হয়তো আর পাঁচতারা সাজে নেই, কোলাহল নেই, কিন্তু আলো আছে—এক নিঃশব্দ, আত্মমগ্ন আলো। যা নিভে যায় না, শুধু দিক বদলায়। পরীমনি সেই আলো—যিনি ঝড় পেরিয়েও নিজের পথ খুঁজে নেন, নিজের মতো করেই বাঁচেন। তাই তো পরীমনির জন্মদিন মানে আজও খবর। সমালোচকদের মতে, পরীমনি এমন এক নারী, যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষতকেও রঙিন করে তোলেন নিজের শিল্পে, নিজের অস্তিত্বে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.