মাদকে জড়াচ্ছেন পিআইওরা ঘুষ-দুর্নীতিও লাগামহীন

0
119

উপজেলা পর্যায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ ‌‘উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা’ (পিআইও)। সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে এই কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। তবে বর্তমানে কর্মরত পিআইওদের বড় অংশের বিরুদ্ধে গুরুতর নানা অভিযোগ উঠেছে। অন্তত ২০৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে ৪৭ জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ মাদক সেবনের। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পের কাজ না করে অর্থ ভাগাভাগি করা, পুরো টাকা তুলে নেওয়া, ভুয়া প্রকল্প দেখানো ও বিল পরিশোধের সময় ঠিকাদারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আছে।

দেশে মোট উপজেলা ৪৯৫টি। এ হিসাবে মোট পিআইওর ৪১ শতাংশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরাই এসব অভিযোগ দিয়েছেন।
জানা গেছে, জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া হলেও সেগুলো অনেক সময় সরিয়ে ফেলা হয়। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অসাধু কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ পিআইওদের রক্ষায় কাজ করেন। তাদের কারণেই অভিযোগগুলো হাওয়া হয়ে যায়।

পিআইওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে চাননি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, পিআইওদের বিরুদ্ধে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। আর মাদক সেবনকারী কর্মকর্তারা গুরুতর অপরাধ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি নিজেই কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

পিআইওদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, পিআইওদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ খুব নতুন কিছু নয়। কমবেশি সবাই এ বিষয়ে জানে। তবে মাদকাসক্তির যে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিরা করেছেন, তা খুবই ভয়ংকর। দ্রুত নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সংস্থা দিয়ে এর তদন্ত করানো প্রয়োজন। অভিযোগ সত্য হলে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা প্রয়োজন।

আবদুল আউয়াল মজুমদার আরও বলেন, ‘আমি খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (তখন একই মন্ত্রণালয় ছিল) মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলাম। একাধিকবার সচিবের দায়িত্বেও থেকেছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পিআইও মাদকাসক্ত হলে তাঁকে চাকরিতে রাখার কোনো সুযোগ নেই। মাদকাসক্ত কাউকে দিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রশ্নই ওঠে না।’

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো চিঠিতে অভিযোগ করেছেন যে, সেখানকার পিআইও মো.  সিরাজুদ্দৌলা গত সাড়ে চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন বাবদ কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন। তিনি নিয়মিত অফিস করেন না। প্রতিনিয়িত মাদক সেবন করেন। তার রুমে সব সময় ফেনসিডিল পাওয়া যায়।

কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দিলেও অপরাধ কমছে না। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পিআইও মাহমুদুল ইসলাম ২০১৭-২০১৮ সালের টিআর কর্মসূচির আওতায় তিনটি অস্তিত্ববিহীন প্রকল্পের বিল-ভাউচার তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির যোগসাজশে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও এর সত্যতা মেলায় তিনি সেই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন। এর পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়।

বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এবং পিআইও মাহমুদুল ইসলাম নিজেও তা স্বীকার করেন। এর পর তাঁর তিন বছরের বর্ধিত বেতন কর্তন করেছে মন্ত্রণালয়।  গত ৪ জানুয়ারি এ আদেশ দেওয়া হয়। সমকালের কাছে মাহমুদুল দাবি করেন, এটি ভুলবশত হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণসহ নানা অনিয়মে অভিযুক্ত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক পিআইও নুরুন্নবী সরকারকে বরখাস্ত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এর আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে নুরুন্নবী সরকারকে বান্দরবান সদর উপজেলায় বদলির আদেশ দেয় অধিদপ্তর। তবে বান্দরবানে যোগদান না করায় তাঁকে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্তির আদেশ দেওয়া হয়। এর পরও প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেননি তিনি। ২০১৫ সালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় যোগদানের পর থেকে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন নুরুন্নবী। গত পাঁচ বছরে হামলা-মামলা ও ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাগুলো বর্তমানে চলমান।

অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত হয়েছেন নড়াইলের লোহাগড়ার পিআইও এস এম এ করিম। সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এ বরখাস্তের আদেশ দেয়। আদেশে বলা হয়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে লোহাগড়া উপজেলার সেতু নির্মাণ খাতের ১৬টি প্রকল্পের শিডিউল বিক্রির সংখ্যা কম দেখিয়ে পিআইও করিম ৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া তিনি সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। নড়াইলের জেলা প্রশাসক এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অধিদপ্তরে দিয়েছিলেন।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সাবেক পিআইও আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। দুদক বগুড়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এতে পিআইও আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে কাজ না করেই ২৯৫টি ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার পিআইও মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ওই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। উপজেলা পরিষদের সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে সম্প্রতি বাগ্‌বিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। সভায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা পিআইওর বিচার ও প্রত্যাহারের দাবি করেন।

এর আগে ওই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটির চেয়ারম্যান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেখানে বলা হয়, পিআইও মাইদুল চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় না করে নামমাত্র ত্রাণ বিতরণ করে বাকি সব নিজেই আত্মসাৎ করেন। ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করেও বিল উত্তোলন করেন। এ ছাড়া টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পগুলোতে ২০ শতাংশ কমিশন না দিলে বিলে সই করেন না।

চট্টগ্রামের পটিয়ার পিআইও অফিসে ঘুষ চলে প্রকাশ্যেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের লিখিত অভিযোগ মতে, প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে ঘুষ আদায় করা হয়। ঘুষের টাকা দিতে না চাইলে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। দীর্ঘদিন এই অফিসে ঘুষ নেওয়া হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় ৩১৮ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব চাল ওঠাতে অফিস খরচের কথা বলে ৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পিআইও অফিসের কর্মচারী জীবনচন্দ্র।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.