আপনাকে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান

0
115

ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা আমরা উদযাপন করে থাকি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে এটি এখন সর্বজনীন উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে থাকে। কারণ এর সঙ্গে সর্বজনীন ছুটি, উৎসব ভাতা, বিপুল কেনাকাটা জড়িত। এর সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাই এ দেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যায়। ঈদ হয়ে ওঠে সবার আনন্দ ও সামাজিক সম্প্রীতির উপলক্ষ।

শৈশবের দিকে যদি তাকাই, তাহলে মনে করতে পারি, গত শতকের চল্লিশের দশকে আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু হতো চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে। এখনকার মতো আগে চাঁদ দেখা কমিটি ছিল না। এত সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনও ছিল না। থাকলেও সেটা প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাত না। মনে পড়ে, নতুন চাঁদ দেখার জন্য আমরা খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়াতাম। নারীরা বাঁশবাগানের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকত বাড়ির উঠোন থেকেই। ২৯ রমজান থেকেই চলত চাঁদ দেখার এই পর্ব।

ঈদের দিন যে আয়োজন ঘিরে আমরা শৈশবে খুব উৎসাহ পেতাম, সেটা হলো ঈদের দিন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, মিষ্টান্ন খাওয়া। ঈদের দিনে ঈদের নামাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে সবাইকে সালাম করা এবং সালামি পাওয়ার একটি বিষয় ছিল। এখনও এটা তেমন প্রচলন আছে কিনা, ঠিক জানি না। এখন বুঝি, এর মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যে সামাজিকতার নবায়ন হতো। এখন দেখি, বিষয়টি অনেক বদলে গেছে। ঈদের সময় সামাজিকতার বদলে এখন অনেকেই নিজে নিজেই ঘরবন্দি থাকে। কেউ বিদেশে চলে যায়।

ঈদে ছুটি এখন অনেক বড় বিষয়। আমাদের সময় এত মানুষ অফিস-আদালতে, কল-কারখানায় চাকরি করত না। গ্রামাঞ্চলে চাকরি বলতে ছিল স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষকতা। সেখানেও এত নিয়মের ব্যাপার ছিল না। বেশিরভাগ মানুষ কৃষক অথবা অন্যান্য স্বাধীন পেশাজীবী ছিল। ফলে এখন যেভাবে ছুটি নিয়ে চুলচেরা হিসাব হয়, সেটা তখন ছিল না। অবশ্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ছুটির বিষয়টি ছিল। আমি যেহেতু ক্লাস এইট পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো স্কুলে পড়িনি; শিক্ষক ও রাজনীতিক বাবার কাছেই বাড়িতে থেকে পড়েছি; ঈদের ছুটির বিষয়টি বুঝতাম না। সেই অর্থে প্রথম ঈদের ছুটি উপভোগ করতে শুরু করি সিলেটের এমসি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। সেই সময়ে রমজান ও ঈদুল আজহার ছুটিতে সিলেট থেকে মৌলভীবাজারে, বাড়িতে যেতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সেটা নতুন মাত্রা পেল। যাদের বাড়ি সিলেট অঞ্চলে তারা ঢাকা থেকে ট্রেনে একত্রে যেতাম। পুরো কম্পার্টমেন্ট দখল করে যাত্রাপথে হইচই, আনন্দ করতাম।

পরে যখন নিজেদের পরিবার হলো, তখন ঈদের আনন্দ আরেক দফা নতুন মাত্রা পেল। আমার স্ত্রী তাঁদের পরিবারের বড় সন্তান। তাই ঈদের দিন সবাই আমাদের বাসায় চলে আসত। এইভাবে বেশ কয়েক বছর চলেছে। পরে আবার একে একে সবার বাড়িতে যাওয়া শুরু হলো। এখন আমরা যেটা করছি, সবাই মিলে কোনো একটা রিসোর্টে চলে যাই। এভাবে চলে আসছে বছর ১৫ হলো। আমাদের সব পক্ষের আত্মীয়রা সেখানে থাকেন। সবাই মিলে একটি দিন আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করে ফিরে আসি।

ঈদের যে আর্থসামাজিক দিক আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়; বছরে এক-দুইবার হলেও শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আবাস গড়েছে। রাজধানীতে কর্মব্যস্ততার চাপে চিড়েচ্যাপটা হওয়া মানুষের কাছে ঈদে বাড়ি ফেরা যেন মুক্তির ছোঁয়া। তাই ঈদ শুধু উৎসব নয়; নগরবাসীর কাছে নাড়ির টানে গ্রামে ফেরার আয়োজন। এই স্রোতে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত কোনো ভেদাভেদ থাকছে না। বাংলাদেশের মানুষ ঈদে গ্রামের বাড়িতে যায় উৎসবের সময়টুকু স্বজনদের সঙ্গে কাটাতে। যাদের গ্রামের সঙ্গে যোগসূত্র আছে, তারাই গ্রামে যায়। আমার মনে হয়, এই যোগসূত্র থাকা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের আগেকার দিন এখন আর নেই। সময় অনেকটাই পাল্টে গেছে। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে। মানুষের আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে কেনাকাটার সামর্থ্যও। আর এই কেনার সামর্থ্যকে পুঁজি করে বেড়ে গেছে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি। এর প্রভাব সারাবছরের অর্থনীতিতে পড়ে। অনেক শিল্প ও পেশা রয়েছে, যেখানে ঈদের বিক্রি বা আয়ের জন্য সারাবছর ধরে প্রস্তুতি চলে।

দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও চাহিদায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। ঈদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এত দিন পোশাক আর জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মানুষ নানা ধরনের পণ্য কিনছে। ইলেকট্রনিক পণ্য যেমন কিনছে, তেমনি উপহারও দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে আবার অনলাইনে কেনাবেচা। যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফোনভিত্তিক আর্থিক সেবা। আগে যেখানে আত্মীয়স্বজনকে অর্থ পাঠাতে মানি অর্ডার বা বাহকদের ব্যবহার করা হতো, এখন সেখানে ঘরে বসেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অর্থ পাঠানো যাচ্ছে। আর্থিক সেবা খাতে এটা এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

ঈদের অর্থনীতি প্রসঙ্গে আমার একটি পর্যবেক্ষণ হলো, ভোগ্যপণ্যে দেশের ভেতরে কতখানি মূল্য সংযোজন হচ্ছে। কারণ অনেক পণ্যই আমদানি হয়ে আসে; ফলে দেশীয় অর্থনীতির খুব বেশি লাভ হয় না, বরং বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। আমরা যদি সর্বক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলে ঈদের অর্থনৈতিক তাৎপর্য আরও বেড়ে যেত।
ঈদ উপলক্ষে দেশের পর্যটন খাতও প্রাণ পায়। আমাদের মতো অনেক পরিবার সময়টা রিসোর্টে কাটায়, সেটা আগেই বলেছি। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, পার্বত্যাঞ্চল, সুন্দরবন বা হাওরাঞ্চলেও অনেকে বেড়াতে যায় এই ছুটির সময়। আমার ধারণা, নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত হলে এই সময় পর্যটন আরও বাড়বে।

ঈদুল ফিতরের অর্ন্তনিহিত তাৎপর্যগুলোর একটি হচ্ছে বৈষম্য কমানো। যেমন সামাজিক বৈষম্য, তেমনই অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো। উৎসবের মধ্য দিয়ে সবাই যেমন আনন্দ ভাগ করে, তেমনই জাকাতের মধ্য দিয়ে ধনসম্পদের বৈষম্য কমানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিষয়টি যদি আরও আন্তরিকভাবে, সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যেত, তাহলে ঈদুল ফিতর হয়ে উঠত আরও সার্থক।

ঈদুল ফিতরের মধ্যে সাম্যের বার্তাটিও আমাদের গ্রহণ করতে হবে। সেই বার্তার মূলকথা– সবার ‘হক’ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহজভাবে বলেছেন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ধর্মের কারণে, সম্প্রদায়ের কারণে, ভৌগোলিক কারণে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। এটাকে আমরা এখন বলি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বা টেকসই উন্নয়ন। ঈদুল ফিতরের বার্তাও একই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর বিখ্যাত সংগীতে আপনাকে বিলিয়ে দেওয়ার আসমানী তাগিদের কথা বলে গেছেন।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থনীতিবিদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.