দেশলাইয়ের বাক্সে লুকিয়ে রাখা যাবে, এত সূক্ষ্ম সেই শাড়ি। ঢাকাই মসলিনের নাম। বানাতে নিষেধ করে কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। সে কারণেই এটা হারিয়ে গেছে। কিংবদন্তি এ মসলিন আবার ফিরেছে, সে কথা অনেকেরই জানা। সেই ঢাকাই মসলিনের শাড়ি, ওড়না, কামিজ দেখা যাবে ঢাকায়। ঢাকার মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, যশোরের নকশিকাঁথা, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এ রকম ঐতিহ্যবাহী প্রায় ২৫টি হস্তশিল্পপণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হস্তশিল্পীরা অপেক্ষা করছেন রাজধানীর রেডিসন ব্লু হোটেলের উৎসব মিলনায়তনে। সেখানে বসেছে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পপণ্যের দুই দিনের প্রদর্শনী। এ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ হেরিটেজ ক্র্যাফটস ফাউন্ডেশন।
আজ শুক্রবার সকালে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। তিনি বলেন, ‘শৈশবে কামারদের মাটির হাঁড়ি তৈরি করতে দেখেছি। ঘানিতে তেল তৈরি করতে দেখেছি। ঘরে তৈরি করতে দেখেছি চিড়া-মুড়ি। আমার এলাকা সিরাজগঞ্জে এ রকম অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিস আছে। এগুলো এখন আরও উন্নত হয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তিতে যতই অগ্রসর হই না কেন ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের এই ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের ধরন বদলায়, কিন্তু ঐতিহ্য হারায় না। শিল্পী ও উদ্যোক্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যকে সামনে এগিয়ে নেওয়া। হেরিটেজ ক্র্যাফটস ফাউন্ডেশন সে রকম একটি কাজই করছে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত ত্রান ভান খোয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন এ আয়োজনের উদ্যোক্তা বাংলাদেশ হেরিটেজ ক্র্যাফটস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তুতলি রহমান। আরও বক্তব্য দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট রোকিয়া আফজাল রহমান, বাংলাদেশ হেরিটেজ ক্র্যাফটস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মো. মনজুর কাদের, গুলশান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত আবু খায়ের মোহাম্মদ, ডলি ইকবাল প্রমুখ।
কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘ঐতিহ্য আমাদের জাতিগত পরিচয়কে তুলে ধরে। আধুনিক বিশ্বে আমরা বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আর সেই বাঙালিয়ানা মিশে রয়েছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভেতরে।’ রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘তুতলি স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। যে আয়োজন নিয়ে আজ সে হাজির হয়েছে, তা অনেক প্রান্তিক মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের কাজ করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দিয়েছে।’ স্বাগত বক্তব্যে তুতলি রহমান বলেন, ‘এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আমরা দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। আমাদের শিল্পীদের হাতের কাজ খুব সুন্দর, আমরা একে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি। আমাদের এ অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’

প্রদর্শনীতে আসা যশোরের তাঁতশিল্পী শুক্লা জানান, তসর, সুতি, হ্যান্ডি সিল্ক ও মসলিনের ওপর নকশা করা শাড়ি, চাদর ও কাঁথা তৈরি করেন তিনি। ৪ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় নকশা করা সেসব শাড়ি বিক্রি করেন তাঁরা। প্রদর্শনীতে রয়েছে জামদানি, খাদি ও মসলিনের পোশাক, নানা রকম পাটজাত পণ্য, টাঙ্গাইলের পুঁতি ও মুক্তার মালা, রিকশাচিত্রের তৈজসপত্র, মণিপুরি গামছা। এ ছাড়া রয়েছে হারবাল কসমেটিকস, বিভিন্ন রকম পিঠা, হাতপাখা, মৃৎপাত্র ও টেপাপুতুল, আচার, মধু, চা, হোগলা ও খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরি পাত্র। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী শেষে ছিল ফ্যাশন শো। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন, জামদানি, সিল্ক, খাদি কাপড়ে তৈরি আধুনিক নকশার শাড়ি, পাঞ্জাবি, কামিজ পরে উপস্থিত অতিথিদের সামনে তুলে ধরেন তরুণ মডেলরা।

দেশের মুমূর্ষু ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশা নিয়ে গত বছরের মে মাসে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ হেরিটেজ ক্র্যাফটস ফাউন্ডেশন। আজ ও আগামীকাল শনিবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। কাল সমাপনী আয়োজন বসবে বেলা ১১টায়। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত অরুনরাং ফতং হামফ্রেস। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের।