মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিতে বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র—এ কথা কমবেশি সবাই জানে। ইরানের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক থেকে শুরু করে ইসরায়েল পর্যন্ত প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে মার্কিন প্রভাববলয়ে রয়েছে।
ঐতিহাসিক এই প্রভাবের অন্যতম ভিত্তি অস্ত্র ও জ্বালানি বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতার মতো বিষয়। এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব এতটাই প্রকট যে হালের ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলে ছুটে গেছেন।
২০২৩ সাল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা শুধু ফিলিস্তিন–ইসরায়েলের মধ্যে চলমান প্রাণঘাতী সংঘাতের জন্য নয়। বরং বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাববলয়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর বছর ২০২৩। আর এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। বর্তমান বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুটি দেশ। তাই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়াতে চাইবে চীন–রাশিয়া, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে বিদায়ী বছরে চীন ও রাশিয়ার কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করে, এ অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে কতটা মরিয়া। বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চমক নিয়ে হাজির হয় চীন। প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরানকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনে তারা। বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় চুক্তি করে দেশ দুটি।
২০২৩ সালের প্রথম চমক আসে ৬ মার্চ। চীনের মধ্যস্থতায় আয়োজিত সংলাপে অংশ নেন সৌদি আরব ও ইরানের প্রতিনিধিরা। এর পরপর রিয়াদ ও তেহরান ঘোষণা করে, শীতল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হবে। এরপর ৬ এপ্রিল বেইজিংয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহান বৈঠক করেন। এরপর সই হয় ঐতিহাসিক চুক্তি। চালু হয় দুই দেশের বন্ধ দূতাবাস।
ওই সময় বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছিলেন, সৌদি–ইরানের ঐতিহাসিক চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের নেতৃত্বদানের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথ সুগম করেছে। এর মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ অঞ্চলে অনেকটা এগিয়ে গেছে বেইজিং। মধ্যস্থতায় চীনকে বেছে নেওয়ার বড় কারণ, সৌদি আরব ও ইরান—উভয় দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে বরাবরই বাড়তি সতর্কতা মেনেছে চীন। কিন্তু সৌদি আরব ও ইরানকে কাছাকাছি আনতে দেশটি তৎপর হয় কৌশলগত কারণে। কেননা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের জন্য এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবের জ্বালানি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে চীন। আর পুরোনো মিত্র ইরানের সঙ্গেও বিপুল জ্বালানি বাণিজ্য রয়েছে বেইজিংয়ের।
বিদায়ী বছরে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় যোগ দিতে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সৌদি আরব। এটাও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বড় অর্জন। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে চীনের বাজারে সৌদি আরবের জ্বালানি তেল রপ্তানি আরও বাড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের এমন দহরম–মহরম নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের জন্য একটি সতর্কবার্তা। মিসর ও ইসরায়েলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল সি কার্টজার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সরাসরি হুমকির কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক (ভূরাজনৈতিক) ব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে।’
যদিও গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাত শুরু হলে অনেকটা সংযত ও সতর্ক আচরণ করছে বেইজিং। শান্তি ফেরাতে আহ্বান জানানো, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বাইরে দেশটির বড় কোনো সম্পৃক্ততা চোখে পড়েনি। যদিও গাজা পরিস্থিতি নিয়ে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনকে ‘গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা’ পালন করার আহ্বান জানান তিনি।
গাজা সংকটের আগে বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় সংকট ছিল ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ। প্রায় তিন মাস ধরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ অনেকটা আড়ালে চলে গেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন, এরপর থেকে মস্কোকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুগিয়েছেন সি চিন পিং।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধে ‘বিতর্কিত’ ভূমিকার জন্য পুতিনের বিরুদ্ধে গত মার্চে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এ জন্য তাঁকে খুব একটা বিদেশ সফরে যেতে দেখা যায় না। ওই পরোয়ানার মধ্যেই ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন পুতিন। সেখান থেকে যান সৌদি আরবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য নয়। তাই দেশ দুটিতে এই আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর হবে না। এ কারণে বিদেশ সফরে এই দুটি দেশ বেছে নেন পুতিন। এটা একদিকে যেমন কৌশলগত একটি সিদ্ধান্ত, তেমনি এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সখ্যের প্রমাণ।
পুতিন এমন এক সময় মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান, যখন নিত্যদিন গাজায় রক্ত ঝরছে। রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনে হামলা অব্যাহত রাখলেও সফরে গিয়ে পুতিন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরানোর গুরুত্বের কথা বলেন। সেই সঙ্গে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে ভারসাম্য ফেরানোর কৌশল নিয়ে কথা বলেন তিনি।
রাশিয়া ও সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দৈনিক বৈশ্বিক উত্তোলনের এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশ দুটি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পুতিনের সৌদি সফরের সময় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।
সর্বোপরি বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত খেলায় বিদায়ী বছরে সাফল্য দাবি করতে পারে চীন ও রাশিয়া। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বিস্তর। জার্মানিভিত্তিক আর্নল্ড-বার্গস্টেইসার-ইনস্টিটিউট ফ্রিবার্গের অ্যাসোসিয়েট ফেলো জুলিয়া গুরল-হলারের কণ্ঠে তেমনই আভাস পাওয়া গেল। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘দীর্ঘ ও বন্ধুর’ পথ পাড়ি দিতে হবে।
অনিন্দ্য সাইমুম