বিরোধী দলীয় সদস্যদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও মঙ্গলবার ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল পাস হয়েছে সংসদে। যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, ইসির ক্ষমতা কমেনি। কিছু কেন্দ্রে গণ্ডগোল হলে পুরো কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক। তাই এই সংশোধনী আনা হয়েছে।
তবে বিরোধী দলের সদস্যরা বলছেন, ইসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ইসি প্রয়োজনে ক্ষমতা ব্যবহার করবে। ক্ষমতা কেড়ে নিলে প্রয়োজন হলেও ব্যবহারের সুযোগ থাকবে না। সংবিধান অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন আভাস দিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারি মাসের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হবে।
বর্তমান আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ইসি যদি মনে করে তারা আইনানুগ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করতে পারে। এখন এই ক্ষমতা সীমিত করে ইসিকে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের (অনিয়মের কারণে) ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো আসনের পুরো ফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফল বাতিল করে ওই সব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে ইসি।
এ ছাড়া সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সরকারি সেবার বিল পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগে মনোনয়ন দেওয়ার ৭ দিন আগে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হতো।
বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরাম সদস্য মোকাব্বির খান নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশে আইন হয় ব্যক্তি, গোষ্টী ও সরকারের স্বার্থে। বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থা এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে মানুষ এখন ভোট বিমুখ। যারা সরকার উৎখাতে আন্দোলন করছে তারাও এর জন্য কম দায়ী নয়। তারা এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার করেছিল।
মোকাব্বির খান বলেন, দেশের মানুষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ। এ ধরনের নির্বাচন বাংলার মানুষ আর চায় না। মানুষ চায় একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে বিরোধী দলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন-আমরা যদি ভোট চোর হই তাহলে বিএনপি ভোট ডাকাত। এই চরম সত্যটা স্বীকার করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, জনগণ ভোট চোর বা ভোট ডাকাতদের খেলার দর্শক হিসাবে আর থাকতে চায় না। জনগণ ভোট চোরকেও চায় না, ভোট ডাকাতদেরও চায় না। এ ধরণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও শুনতে চায় না। জনগণ চায় তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন। সেখানে সে নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে প্রত্যেকটি দলীয় সরকারের অজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসাবে সরকারের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন সর্বকালের অজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, ইসিকে ভোট বন্ধের ক্ষমতা না দিলে এই ইসি দিয়ে কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। আইনে ইলেকশনের স্থলে পোলিং শব্দটা এনে বড় পার্থক্য করা হয়েছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিধানের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
পীর ফজলুর রহমান বলেন, এই আইনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি। নির্বাচনের বিষয়ে অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসেও নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়নি। তিনি বলেন, আগে যেখানে পুরো ভোট বন্ধের সুযোগ ছিলো সেটা বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
বিরোধী সদস্যদের এসব সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, একটি নির্বাচনী আসনে ১০০-১৫০টি ভোট কেন্দ্রে থাকে। সেখানে ৩-৪টি কেন্দ্রে কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম হলে সবগুলো কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। সেটা জনগণের ভোটাধিকারেরও পরিপন্থী। কারণ বাকিগুলিতে তো কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম হয়নি। কেবল তিনটায় হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার কথা অমূলক। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জনগণকে যে অঙ্গিকার দিয়েছেন তা পালন করার জন্য সরকার সচেষ্ট।
আইনমন্ত্রী দাবি করেন, ঋণ খেলাপি ব্যাংকে যেন টাকা ফেরত আসে এবং অর্থঋণ আদালতের উদ্দেশ্য যাতে প্রতিপালিত হয় তার জন্য এটা করা হয়েছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য এটা করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, একজন বলেছেন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই অন্যরকম। এটা আমি সাহসের সঙ্গে বলতে পারি- আওয়ামী লীগ সরকারের আন্ডারে যত নির্বাচন হয়েছে। সবগুলোই কিন্তু সকল পক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে বলেছে। আপনি বলেন সংসদ নির্বাচন, আপনি বলেন সিটি করপোরেশন নির্বাচন বলেণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন-সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।