ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম কেন কমছে না

0
182
ইলিশ

ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। ফলে বেশির ভাগ মানুষের পাতে এখনো ইলিশ ওঠেনি। বাজারে গেলে ইলিশের চড়া দাম নিয়ে ক্রেতাদের ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ফেসবুকে সম্প্রতি একটি স্ট্যাটাস বেশ ছড়িয়েছে। সেটা হলো ‘ইলিশ ঘাস খায় না, খড় খায় না, খইল, ভুসি বা ফিডও খায় না! ইলিশের জন্য চিকিৎসা খরচ নাই, ইলিশ চাষ করতে দিনমজুরও রাখা লাগে না! ইলিশ ইউক্রেন-রাশিয়া থেকেও আসে না কিংবা ইলিশ পুকুরেও চাষাবাদ করা হয় না! নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরে আনা ইলিশের দাম গরু, ছাগলের মাংস থেকেও অনেক বেশি। এর জন্য দায়ী কে?’

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় জেলে, ট্রলারমালিক, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মৎস্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাদের কথায় বের হয়ে আসে, সাগরে ইলিশ মিললেও নদ-নদীতে এখন খুব একটা দেখা মিলছে না ইলিশের। আর নদীর ইলিশ সুস্বাদু হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে এই ইলিশের চাহিদা বেশি। নদীর ইলিশ চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় এখনো আকার ভেদে দেড় হাজারের নিচে খুচরা বাজারে ইলিশ মিলছে না।

বাজারে সাগরের যে ইলিশ মিলছে তার দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। এর পেছনের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, জ্বালানি তেল, বরফ, নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। এগুলোর প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক ইলিশের দামের ওপর।

ইলিশ ধরার ব্যয় আসলে কত

মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সমুদ্রগামী ট্রলারগুলোর জ্বালানি, পরিচালনা, জেলেদের খোরাকি ব্যয়, বরফ, মজুরি মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ফলে আহরিত মাছ বিক্রি করে ব্যয় তুলে লাভ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বছরে এখন সব মিলিয়ে আট মাস নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেরা খুব বেশি সময় মাছ ধরার জন্য পান না। মাছ ধরার সময়কাল কমায় তাদের আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে।

পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামের এফবি মায়ের দোয়া নামে একটি  ট্রলারের মালিক জাহাঙ্গীর খান গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারের ব্যয়ের একটি হিসাব দেন। তিনি বলেন, ট্রলারে মাঝিসহ ১৯ জেলে থাকেন। ট্রলারটিতে জ্বালানি তেল লাগে ১২ ব্যারেল। এর দাম পড়ে দুই লাখ ৮৮ হাজার টাকা। মবিলের খরচ পড়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা, বরফ লাগে ৬৫ হাজার টাকার। জেলেদের অন্তত ১০ দিনের বাজার খরচ দেড় লাখ টাকার মতো। যন্ত্রাংশের জন্য ২০ হাজার টাকা, ওষুধপত্রের ৫ হাজার টাকা, ২ হাজার টাকার পানের পানি, অন্যান্য খরচ সাড়ে ৭ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে একটি ট্রলার ১০ দিনের জন্য গভীর সাগরে পাঠালে সাড়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এরপর শ্রমিকদের মজুরি, ঘাটের ইজারা, মাছঘাটের শ্রমিকের মজুরি, পাইকার, আড়তদারের কমিশনসহ অনেকগুলো খাতে টাকা যায়। খরচ ওঠাতে হলে একটি ট্রলারকে অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে হয়। এরপরে যত বেশি ইলিশ ধরা পড়বে, লাভের পরিমাণ তত বাড়বে।

গভীর সাগরের মতো উপকূলে মাছ ধরার ট্রলারপ্রতি খরচও বেড়েছে বলে হিসাব দেন পাথরঘাটার আরেক ট্রলারমালিক মোহাম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, আগে সব মিলিয়ে খরচ হতো ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকার মতো। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ টাকা।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারমালিকেরা বলছেন, এখন প্রতিটি ট্রলার (জাহাজ) সাগরে পাঠাতে তাদের ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। ফলে মাছের দাম বাড়িয়ে তাদের ব্যয় সমন্বয় করতে হয়। এতে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষকে বেশি দামে মাছ কিনে খেতে হয়।

বরগুনা জেলা ট্রলারমালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, তাতে আমাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। সরকার সমুদ্র অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় এই খাত এখন হুমকির মুখে। ইলিশ মাছের জোগান এক দিকে কমে যাচ্ছে, অপর দিকে আহরণ ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়ছে।’

ইলিশের দাম কেন বাড়ছে

জেলেরা বলছেন, আগে নদ-নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলত। এসব ইলিশ স্থানীয় বাজারে প্রান্তিক জেলেরা সরাসরি বিক্রি করতেন। ফলে  মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ছিল না। দাম কম পড়ত। এখন জেলেরা যে ইলিশ পান তা বিক্রি করতে হয় পাইকারি বাজারে। এই বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের অন্তত ছয়টি চোরা ফাঁদ আছে, যেখানে হাত বদল হলেই দাম বেড়ে যায়।

চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন, ইলিশ ঘাস খায় না, চাষ হয় না বলে ব্যয় হয় না, তা নয়। ইলিশ আহরণের ব্যয় বেড়েছে, বাজারজাত করার ধাপে ধাপে খরচ বেড়েছে। এই সময়ে চাঁদপুরে ১০ থেকে ১৫ হাজার মণ ইলিশ আসত, এখন আসছে ২০০ থেকে ৩০০ মণ। সব মিলিয়ে দাম কমার সুযোগ একেবারেই কম।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো ফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ। সমুদ্রে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত ২০০টির বেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এবং ৬৭ হাজারের বেশি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকা এ খাতে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ ভাগ জোগান দেয়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, মৎস্যজীবীরা এখনো প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদের প্রায় ৮৩ শতাংশ আহরণ করেন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মৎস্য গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির সম্ভাবনাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। সাগর, নদ-নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশের কারণে সবচেয়ে বেশি ইলিশ এখানে ছুটে আসে। গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেড়ে যায়। কিন্তু ইলিশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এখন আর দেশে সে ধরনের প্রকল্প ও কার্যক্রম নেই। ডুবোচর, দূষণ ও নিষিদ্ধ জালে ঘিরে রাখায় ইলিশ আর নদীতে ঢুকতে ও টিকতে পারছে না। ফলে ইলিশের জোগান এ বছর আশঙ্কাজনক হারে কম। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় ইলিশের দাম বাড়তি।

এম জসীম উদ্দিন

বরিশাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.