বয়সী এক বৃক্ষের কথা

0
161
পাতায় পাতায় আরও ঝাঁকড়া, আরও প্রশস্ত হয়ে উঠেছে গাবগাছটি। বয়স আনুমানিক ১৫০ বছর। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ভূমিউড়া গ্রামে

সবুজ তাঁবুর মতো অসংখ্য বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। দুই ডানার নিচে ছানাপোনাদের আগলে রাখা বিশাল কোনো পাখির মতো দেখায় গাছটাকে। বয়সী এই গাছটা কোনো পুরোনো সময়ের ওম জমা রেখে দিয়েছে নিজের ভেতরে। এই সময়ের মধ্যে দেশ বদলেছে, মানুষ বদলেছে। আর গাছটি নির্লিপ্ত সুখে শাখা-প্রশাখায় হয়ে উঠেছে পাতায় পাতায় আরও ঝাঁকড়া, আরও প্রশস্ত। বয়সীও হয়েছে আরও বেশি।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ভূমিউড়া গ্রামে গাবগাছটির কথা বলছি আমরা। গাছটির বয়স আনুমানিক ১৫০ বছর।

বৈশাখের এক দুপুরবেলা। বৃষ্টি নেই বহুদিন। তবু আমরা যেদিন গেলাম, ঠিক সেদিনই আকাশে মেঘ উড়তে শুরু করেছে। হালকা ছাইকালো মেঘ। সেই মেঘের ছায়া পড়েছে মাটিতে। একটু মেঘভাঙা রোদ উঠলে ঝলমল করে ওঠে সবকিছু। আবার পরক্ষণেই মন ভার করা মুহূর্ত।

খুব দুর্গম গ্রাম নয়, কিন্তু অচেনা। গ্রামের পাকা সরু সড়ক। কিছু দূর পরপর একাধিক মাটির শাখাপথ এদিক-ওদিক চলে গেছে। কোন দিকে গেলে ভূমিউড়া যাওয়া যাবে, সেটা খুঁজতে গিয়ে পথে পথে অনেকের সঙ্গেই কথা বলতে হয়েছে। তবে গ্রামের ভেতরে এ রকম পথ এখন খুব কমই আছে। কারও পুকুরপাড় ধরে, কারও উঠান, ঘরের বেড়ার পাশ ছুঁয়ে, কারও বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে গেছে ছোট মাটির সড়ক। কোথাও একটু-আধটু ইট বিছানো। এ যেন এক পড়শিকে আরেক পড়শির জড়িয়ে থাকার আয়োজন।

একসময় মাটির গন্ধমাখা দুপুরে এই গাছটিকে দূর থেকেই দেখা যায়। গ্রামের এক প্রান্তে, মাঠের কাছে সারা শরীরভরা সবুজ পাতার সংসার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুয়ে থাকা ডালগুলো মাটির সঙ্গে, পাশের ধানের জমিতে গিয়ে পড়েছে। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে গাছের তলায় যাওয়ার সুযোগ নেই। মাটি ছুঁয়ে থাকা ডালপালা তাঁবুর বেড়ার মতো। তবে পশ্চিম দিক থেকে কিছুটা পথ খোলা। গাছের নিচটা মাটির উঠানের মতো ঝকঝক করছে, একদম ঝাড়ামোছা। হালকা বৃষ্টি গাছের নিচ পর্যন্ত পৌঁছায় না।

পাতার ফাঁকে ফাঁকে সবে গাব ফল ফলেছে, ঝুলে আছে। কোনোটি কাঁচা, সবুজ। কোনোটি পাকা, হলুদ। নিচে অনেক পাকা ফল পড়ে আছে। কিছু পাখি কিচিরমিচির করছে। গাবগাছের এই স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভৈরব থলি। মোজাইক করা সে রকম একটি পাথর স্থাপন করা আছে গাছের নিচে। গাছের একটি ডালে লাল টুনের এক টুকরা কাপড়ও বাঁধা।

সেদিন গাছটি দেখতে গিয়েছিলেন মৌলভীবাজার থেকে রাজন আহমদ ও রাজনগর থেকে আবদুল আজিজ। তাঁরা জানালেন, এই গাছের কথা তাঁরা অনেক আগেই শুনেছেন। কিন্তু কখনো আসা হয়নি। গাছটিকে তাঁরা ঘুরেফিরে দেখছিলেন চোখভরা বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে।

কাছেই গরু চরিয়ে ঘাসের মধ্যে মাথায় ছাতা ধরে বসেছিলেন বাদল দেব। বয়স ৭৬ বছর। গাছটির প্রতিবেশী তিনি। গাছের সঙ্গেই বেড়ে ওঠা তাঁর। গাছটি নিয়ে কথা উঠতেই জানালেন, সেই যখন থেকে বুঝতে এবং মাঠে চাষে যেতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই এই গাছকে দেখে আসছেন তাঁরা। তখন গাছের ডালপালা মাটি থেকে অনেকটা ওপরে ছিল। এখন ডালপালা মাটিতে লেগে গেছে। গাছটি ওপরের দিকে কম বাড়ে, তাই উচ্চতা দেখে ছোটই মনে হয়। কিন্তু বয়স অনেক।

গ্রামবাসী এটাকে ক্যানগাছ বলেন। আবার কারও কাছে কষ, কারও কাছে গাবগাছ। কেন্দরও বলেন কেউ কেউ। আগে আশপাশের জেলেরা মাছ ধরার জালে রং করতে গাব ফল নিয়ে যেতেন। জালে গাবের কষ দিতেন তাঁরা। প্রায় ১৫ বছর ধরে আর কেউ ফল নিতে আসেন না। এখনো ফল ধরে। ফল পাকে, হলুদ হয়ে ঝুলে থাকে। পাখিরা সেই ফল খায়। পাকা ফল মাটিতে ঝরে পড়ে। বৈশাখ মাসে ফল পাকতে শুরু করে। আষাঢ় মাস পর্যন্ত গাছে বেশি ফল থাকে।

গাছটি যে বাড়ির সীমানার কাছে বেড়ে উঠেছে, সেই বাড়ির অংশীজন সুবীর ভট্টাচার্য ও রসরঞ্জন ভট্টাচার্য কাব্যতীর্থসহ অন্যরা জানালেন, গাছটি প্রায় এক বিঘা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে।

বহুবর্ষজীবী গাছটির প্রকৃত বয়স কারও জানা নেই। আন্দাজ করে বলাও মুশকিল। তবে রোপণের সময় হিসাবে যে কথা প্রচলিত, তা অন্তত চার প্রজন্ম আগের। সে হিসাবে গাছটির বয়স মোটামুটি দেড় শ বছরের কম নয়। হিন্দু-মুসলিম অনেকেই গাছটি ঘিরে বিভিন্ন মানত দিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে গাছটি আলাদা সম্ভ্রম ও সম্প্রীতিরও।

দু–একটি করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরতে শুরু করেছে। গাবগাছের পাতায় সেই বৃষ্টির ছোঁয়া। কালের যাত্রায় গাছটি এ রকম বৃষ্টি আর খরার সাক্ষী। কিন্তু সব বদলের ভেতরেও এটি নীরব, নির্বিকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.