বড় তিন সমস্যায় সাত কলেজ

0
108
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ

পরীক্ষার ব্যবস্থাপনায় আগের চেয়ে উন্নতি হলেও গুণগত মানে ঘাটতি। শিক্ষকসংকটে ক্লাস নিতে হিমশিম অবস্থা। শ্রেণিকক্ষ ও গবেষণাগারের সংকট।

২০১৭ সালে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়।

সাত কলেজে শিক্ষার্থী দেড় লাখের বেশি। মোট শিক্ষক ১ হাজার ২২৭ জন।

স্নাতক-স্নাতকোত্তর পড়ানো হয় ২৫টি বিষয়ে।

রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক ক্লাস শেষে হন্তদন্ত হয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। পরে কার্যালয়ে গিয়ে তিনিসহ অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিক্ষকস্বল্পতার কারণে তাঁদের প্রায় প্রতিদিনই চাপে থাকতে হয়।

৮ মে এই বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, বিভাগে শিক্ষক আছেন চারজন। উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ক্লাস, পরীক্ষা—সবই তাঁদের সামলাতে হয়। তাঁদের বাইরে একজন ‘অতিথি শিক্ষক’ আছেন।

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের এই কলেজ ছয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। লক্ষ্য ছিল মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু তা অর্জনে অনেকটাই পিছিয়ে কলেজটি।

দেশের অন্যতম পুরোনো ঢাকা কলেজে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থী পড়েন। এ কলেজে শিক্ষক কিছুটা বেশি। তবু গড়ে ৭৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক।

কারণ হিসেবে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষকেরা বলছেন, শিক্ষকের পর্যাপ্ত সংখ্যা ও মানের ওপর গুণগত শিক্ষা অনেকাংশে নির্ভর করে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে এখন শিক্ষক আছেন ৩৩ জন। এই বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে প্রতিবছর ভর্তির সুযোগ পান ১৫০ জন।

অন্যদিকে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে প্রতিবছর ভর্তি হন ১৭০ জন। এর পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতেও প্রতিবছর ভর্তি হন কয়েক শ শিক্ষার্থী।

শিক্ষকসংকট শুধু সোহরাওয়ার্দী কলেজেই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মোট সাতটি কলেজের অবস্থা কমবেশি একই। বাকি কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এর আগে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত ছিল।

ছয় বছরে সাত কলেজের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য কুদ্দুস শিকদার।

এই সাত কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর সম্প্রতি পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের সময় এবং পাঠ্যসূচি আগের চেয়ে অনেকটা উন্নতি হলেও বড় তিনটি মৌলিক সমস্যা রয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে শিক্ষকসংকট, গবেষণাগার ও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং প্রথম বর্ষের পর থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি কমে যাওয়া।

সাত কলেজের শিক্ষকদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একাডেমিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আছে সাত কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই তিনের সমন্বয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সংকট সমাধান করতে হবে।
আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার, সাবেক অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজ।

সাত বড় কলেজে ওপরের শ্রেণিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়টিও সমস্যা হিসেবে দেখছেন শিক্ষকেরা। আছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি। তাঁরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর এসব কলেজের শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়া হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, এখন সাতটি কলেজে সময়মতো পরীক্ষা হচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বেড়েছে। তবে কলেজগুলোতে তুলনামূলক শিক্ষার্থী বেশি। শিক্ষক না বাড়ালে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া কঠিন। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও মনোযোগী হতে হবে। এ বিষয়ে তাঁরা প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিয়েছেন।

শিক্ষকস্বল্পতা, মানসম্মত শিক্ষা কতটা সম্ভব

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বর্তমানে গড়ে ১৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২ হাজারের বেশি শিক্ষক আছেন। অথচ সাতটি কলেজে দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন ১ হাজার ২২৭ জন।

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে গড়ে ১১২ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক আছেন।

সোহরাওয়ার্দীর পাশেই কবি নজরুল সরকারি কলেজে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১২০ জন শিক্ষক আছেন। কলেজের অধ্যক্ষ আমেনা বেগম বলেন, শিক্ষকসংকটের কারণে তাঁরা সমস্যায় আছেন।

দেশের অন্যতম পুরোনো ঢাকা কলেজে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থী পড়েন। এ কলেজে শিক্ষক কিছুটা বেশি। তবু গড়ে ৭৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক।

২০১৯ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এক সভায় সাত কলেজের অধ্যক্ষেরা প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৬ জন করে শিক্ষক নিয়োগের দাবি তুলেছিলেন। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকেরা বলছেন, এত কম শিক্ষকে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়।

শ্রেণিকক্ষসংকট, ভবন পড়ে আছে

সোহরাওয়ার্দী কলেজে ছোট-বড় ২৬টি শ্রেণিকক্ষ আছে। সরেজমিনে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে দেখা যায়, বিভাগের জন্য তুলনামূলকভাবে বড় একটি শ্রেণিকক্ষ আছে। তবে শ্রেণিকক্ষের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। একটি ছোট সেমিনারকক্ষেও অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। আরেকটি ছোট কক্ষ দুই বিভাগ মিলে ব্যবহার করে। কলেজটিতে নেই আবাসিক হল, আবার যাতায়াতের জন্য নেই কোনো বাসও। ফলে শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়।

সমস্যাগুলো সবার জানা উল্লেখ করে কলেজের অধ্যক্ষ মোহসীন কবীর বলেন, এখন সমাধান হওয়া দরকার।

শ্রেণিকক্ষের সংকট কবি নজরুল সরকারি কলেজেও। ঢাকা কলেজের শ্রেণিকক্ষের সংকট কাটাতে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রায় দেড় বছর আগে ১০ তলা নতুন ভবন শেষ হলেও লিফট না থাকায় ওপরের তলাগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ক্লাস কম, শিক্ষার্থী ঝরে যায়

ঢাকা কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, তাঁদের বিভাগে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ১২০টি আসন আছে। কিন্তু চতুর্থ বর্ষে শিক্ষার্থী ৪০-৫০ জনে নেমে আসে। আবার স্নাতকোত্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি একেবারেই কমে যায়। যেমন ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ১৬ জন। সমস্যাটি প্রায় সব কলেজেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে ক্লাসে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি থাকলে জরিমানা ছাড়াই পরীক্ষা দেওয়া যাবে। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্লাস করলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যাবে। এর নিচে হলে পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। একাধিক শিক্ষক জানালেন, বাস্তবে ‘নানা কারণে’ ছাড় দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।

সময়মতো ফল প্রকাশে উন্নতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়ার পর প্রথম দিকে পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে দেরি হওয়া নিয়ে আন্দোলন হতো। এখন সেই সমস্যা অনেকটাই কেটেছে। কোনো কোনো শিক্ষাবর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর চেয়ে এগিয়ে সাত কলেজ। যেমন সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। এঁদের স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ইতিমধ্যে ফলও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর একই বর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছেন।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিক্ষাবর্ষের সময়কাল কমিয়ে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করা হয়েছিল। কিছু সমস্যা এখনো আছে। এ ছাড়া কলেজগুলোয় একটি উত্তরপত্র একজন পরীক্ষকই দেখেন। এতে মূল্যায়নে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্যায়নে দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা চালু আছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সময় সাশ্রয়ের জন্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের একক মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ

ছয় বছরে সাত কলেজের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য কুদ্দুস শিকদার।

ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, এই সাত কলেজের শিক্ষকদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর একাডেমিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যদিকে আছে সাত কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই তিনের সমন্বয় করে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সংকট সমাধান করতে হবে। তা না হলে কোনো দিনই ভালো কিছু হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.