বড় ঝুঁকিতে রুপালি ইলিশ

0
214
পটুয়াখালীর আলীপুর মৎস্য বন্দরে ইলিশের স্তূপ। ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলে ও পাইকাররা

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে শুক্রবার ইলিশ কিনতে গিয়েছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আজিজুর রহমান। দরকষাকষিতে বিক্রেতার সঙ্গে বনাতে না পেরে ফেরেন খালি হাতে। আজিজুর জানান, কেজি পার হলেই বিক্রেতা প্রতি কেজি ইলিশের দাম হাঁকছেন দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা; ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা।

ভরা মৌসুমে ইলিশের এমন দামের কারণ সরবরাহ কম। আষাঢ়ে মৌসুমের শুরু থেকেই চলছে এই হা-হুতাশ। বৃষ্টি বাড়লে ফিরবে ইলিশ– এমন আশার কথা শুনিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে টানা তিন সপ্তাহের ভারী বৃষ্টির পরও জালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত রুপালি মাছ। মাঝে গত ১৩ আগস্ট পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের শেষ বয়ার কাছে জেলে মিজান মাঝির জালে ধরা পড়ে ৯৬ মণ ইলিশ। এর পর এক সপ্তাহে কিছু ট্রলার বড় ঝাঁকের দেখা পেয়েছে। তবে অধিকাংশই গভীর সমুদ্রে। দেশে ইলিশের মূল জোগান আসে নদী-সমুদ্রের যেই মোহনা থেকে, সেখানে নেই সুখবর। সাগর নয়, নদীর যেই ইলিশের স্বাদের জন্য মাছটির এত নামডাক, সেখান থেকেই অধিকাংশ জেলে ফিরছেন মলিন মুখে।
এমন পরিস্থিতিতে রুপালি মাছটির সাম্রাজ্য বরিশালে চলছে হাহাকার। শ্রাবণ শেষ হয়ে গেলেও আশানুরূপ ইলিশের দেখা না পেয়ে হতাশ ৩৩ বছর ব্যবসা করা বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মোকামের রিয়া মৎস্য আড়তঘরের মালিক নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, গত তিন বছর ভরা মৌসুমে ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের কেজি হাজার টাকার নিচে ছিল। কিন্তু গেল বুধবার একই মাছের পাইকারি দর ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে দু-একটি জালে ইলিশ ধরা দিলেও অধিকাংশ জেলে নিরাশ হচ্ছেন।

তাহলে কি হারিয়ে যাচ্ছে ভোজনরসিক বাঙালির প্রিয় ইলিশ– এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জেলে, ট্রলার মালিক, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মৎস্য বিশেষজ্ঞদের আলাপের সারবস্তু হলো, নানা প্রতিকূলতায় বড় ঝুঁকিতে ইলিশ।

মোহনায় নাব্য সংকট, গতিপথ বদল

ইলিশ সাগরের মাছ। প্রজননের জন্য নদীতে আসে। সাগর থেকে ইলিশের নদীতে প্রবেশের সময় মোহনায় কমপক্ষে ৩৩ ফুট পানির গভীরতা দরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণাঞ্চলে মোহনা ছয়টি। ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এসব মোহনায় এখন পলি জমে নাব্য সংকট। মোহনার মাঝবরাবর গভীরতা একটু বেশি থাকলেও দু’পাশে ভাটার সময় নেমে আসে ৮-৯ ফুটে।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদউল্লাহ জানান, দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের ৭০ শতাংশই আসে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী থেকে। নদী দুটির সাগরের উৎসমুখ চরফ্যাসনের ঢালচর মোহনা। এর এক প্রান্ত পটুয়াখালীর সোনারচর; অন্য প্রান্ত চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত। বর্ষায় থইথই পানি দেখা গেলেও বাস্তবে গভীরতা কম। ভাটার সময় তিন মিটারে নেমে আসে। মোহনা থেকে ভোলার ইলিশা ঘাট পর্যন্ত ১৩০টি ডুবোচর। এসব কারণে ঢালচর মোহনা দিয়ে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় আগের মতো ইলিশ আসছে না। কারণ, ইলিশের বৈশিষ্ট্যই হলো তারা কখনও স্থির থাকে না। চলার পথে বাধা পেলে পথ বদলে ফেলে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার বলেছেন, মোহনায় নাব্য সংকটের বিষয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। খনন না করলে ইলিশ সম্পদের বড় ক্ষতি হবে।

এ ছাড়া মেঘনা থেকে পদ্মা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় দূষণ বেড়েছে। নদীতে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্য কমেছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, গত চার বছরে খাদ্যের পরিমাণ কমার হার ৬ শতাংশ। দূষণের কারণে ইলিশ নদীতে আসছে না; এলেও দ্রুত অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, ইলিশের খাদ্যের ৪২ শতাংশই শৈবাল। এর পরই আছে বালু বা ধ্বংসাবশেষ, ৩৬ শতাংশ। শিল্পসহ নানা বর্জ্য ইলিশের জলজ প্রতিবেশ নষ্ট করছে।

সংস্থাটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে পদ্মা নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০, ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪১। একইভাবে ২০১৮ সালে মেঘনা নদীতে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০, যা ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশে। ডিওর পরিমাণ প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রামের কম হলে তা জলজ পরিবেশের জন্য কম উপযোগী। একইভাবে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত রাসায়নিক যৌগ হলো অ্যামোনিয়া। ভালো পানিতে এর শূন্য উপস্থিতি থাকতে হবে। পদ্মায় ২০১৮ সাল থেকে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি একই, শূন্য দশমিক ৪। তবে মেঘনায় শূন্য দশমিক ২১ থেকে বেড়ে গত বছর হয়েছে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ।

কম উৎপাদনকে ফাঁপানো হচ্ছে

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় অফিস জানায়, মৌসুমের প্রথম মাস জুলাইয়ে ইলিশ আহরণ করা হয় ১৩ হাজার ৩১০ দশমিক ৫০৫ টন, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ১৫ হাজার ১১ দশমিক ৮৬০ টন। জুলাইয়ে বরিশালের বিভিন্ন মোকামে ইলিশ কেনাবেচা হয় মাত্র ৮৭৪ টন, যা গত বছর এই সময়ে হয়েছিল ২ হাজার ৯৩৭ টন।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইলিশের ডিম পাড়ার হার ১১ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণত ডিম যে পরিমাণ ছাড়ে, ইলিশও তার কাছাকাছি পরিমাণে বাড়ে। কিন্তু এ সময়ে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ ডিম পাড়ার হারের তুলনায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।

ইলিশের ডিম ছাড়া ও উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও নদীতে যে কমছে, সেই তথ্য মিলেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটেরই আরেক গবেষণায়। এতে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ সালে পদ্মার ওপরের দিকে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ টন। এটি ২০২০ সালে কমে যায় ৬০৪ টনে। মেঘনায় ২০১৭-১৮ সালে আহরণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৭৭ টন ইলিশ। দুই বছর পর তা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১১১ টন। অর্থাৎ প্রধান দুই নদীতেই দুই বছরে প্রায় ৫০০ টন উৎপাদন কমেছে।

মৎস্য অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, বছর বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩২ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়ে হয় ৫ লাখ ৫০ হাজার টন। এর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে কিছুটা কমে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ আহরণ বেড়েছে। কিন্তু বাজারে গেলে উৎপাদন বাড়ার এই হিসাব মেলে না। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশ আহরণ করা হয়। এ মাছ ধরতে নৌকা ভাড়া ও তেলের খরচ ছাড়া কোনো বড় ব্যয় নেই। এর পরও দেড়-দুই হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এর মানে, যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে বলে বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।

সমুদ্রে মাছ ধরায় সরকারের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার কঠোরভাবে এটি বাস্তবায়ন করলেও একই সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা পালন না করে সাগর থেকে মাছ ধরে নিচ্ছে। জানতে চাইলে ইলিশ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আবদুল ওহাব বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, একেক নদনদীতে একেক সময় ডিম পাড়ে ইলিশ। এ জন্য যখন যে নদীতে ডিম ছাড়বে, তখন সে নদীতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।

ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে অপরিপক্ব ইলিশও মা হিসেবে ডিম ধারণে অভ্যস্ত হচ্ছে। ওই ডিমের উৎপাদন ক্ষমতা কম। নাব্য সংকট, স্রোত কমে যাওয়া, চর-ডুবোচরে বাধা, নদী ও সাগরের পানির অতিরিক্ত দূষণের কারণে ইলিশের জীবনচক্র বদলে যাচ্ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, অনেকেই জুলাই-আগস্টকে ইলিশের ভরা মৌসুম বলেন। আগস্ট থেকে ইলিশ ধরা শুরু হলেও মূলত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বেশি পাওয়া যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.