পদ্মা সেতুর এক বছরে জৌলুশ হারিয়েছে ফেরিঘাট, বেকার হাজারো মানুষ

0
108
পদ্মা সেতু চালুর পর দৌলতদিয়া ঘাটে যানবাহন আর যাত্রী না থাকায় খাবারের হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ রকম দেড় শতাধিক হোটেল–রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে

২৫ জুন পূর্ণ হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। খুলে গেছে বহুবিধ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দুয়ার। কোটি কোটি মানুষ সরাসরি এর সুফল পাচ্ছেন। তবে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া নৌরুট ও ঘাটনির্ভর খেটে খাওয়া কয়েক হাজার মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তাঁরা জীবিকা হারিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

সেতু চালু হওয়ার পরপরই জৌলুশ হারাতে শুরু করে ঘাট দুটি। যাত্রী ও যানবাহন অনেকাংশে কমে যাওয়ায় দৌলতদিয়া ঘাটের প্রায় ৫০০ হকার, দেড় শতাধিক টং (ছোট) দোকান, শতাধিক খাবারের হোটেল ও অনেক আবাসিক বোর্ডিং বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন কয়েক শ পরিবহনশ্রমিক।

বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. সালাহ উদ্দিন জানান, পদ্মা সেতু চালুর আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট দিয়ে ফেরি ও লঞ্চে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজারের বেশি যানবাহন ও লক্ষাধিক মানুষ পারাপার হতো। যানবাহনের চাপে ফেরির অপেক্ষায় মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হতো। আর এখন উল্টো যানবাহনের জন্য দীর্ঘ সময় ঘাটে ফেরিগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে দৈনিক গড়ে দেড় হাজার যানবাহন পারাপার হচ্ছে। তবে এখন মানুষের কোনো ভোগান্তি নেই। সবাই স্বস্তিতে নদী পার হতে পারছেন।

দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় সম্পদ, দেশের অহংকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের অন্যতম নিদর্শন। তবে এ সেতু উদ্বোধনের পর আমাদের এ এলাকায় দুটি ঘাটনির্ভর বহু মানুষের জীবন-জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।’

দৌলতদিয়া ঘাটের মুদিদোকানদার শাহিন শেখ, ইসলাম সরদার, সুমন শেখ, ইমরান হোসেনসহ কয়েকজন বলেন, সেতু চালু হওয়ার দু-তিন মাসের মধ্যে তাঁদের অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যাঁরা এখনো আছেন, তাঁদের বেচাকেনা একেবারে কম। এ দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না।

আরেক দোকানি সুমন শেখ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে দোকান থেকে এক মিনিট বাইরে যাওয়ার সময় পেতাম না। দোকানে যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকত। সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ব্যবসায় পুরোপুরি ধস নামে। দুই মাসের মধ্যেই দোকান বন্ধ করে ফেরির টিকিট বিক্রির কাজ করি। তবে যাত্রী কম হওয়ায় সেখানে তেমন বেতন পেতাম না। এখন নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে পরিবার নিয়ে কোনোভাবে দিন পার করছি।’

দৌলতদিয়া ঘাট নৌযান শ্রমিক লীগ সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ঘাটে আগের মতো গাড়ি না থাকায় অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই এলাকাকে নতুন করে জমজমাট করতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন, ঘাট দুটিকে দ্রুত আধুনিক নৌবন্দরে উন্নীতকরণসহ বিকল্প কর্মসংস্থানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে পাঁচ বন্ধু মিলে প্রায় ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দৌলতদিয়া ঘাটে দিয়েছিলেন ‘কেয়ার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। বিনিয়োগের পুরোটাই লোকসানের মুখে পড়েছেন জানিয়ে রেস্তোরাঁর পরিচালক সেলিম খান বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে পাঁচ বন্ধু মিলে রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু এর কিছুদিন পরই পদ্মা সেতু চালু হলে যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে যায়। পরবর্তী সময়ে রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশনের টাকাই উঠাতে পারিনি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘাটনির্ভর কিছু মানুষের জীবন-জীবিকার প্রভাব পড়ায় গত এক বছরে ঘাটনির্ভর পাঁচ শতাধিক লোক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে গেছেন। সরকারিভাবে অনেক নারী-পুরুষকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এবং ঋণ ও উপকরণ দিয়ে বিকল্প পেশায় পুনর্বাসনে সহায়তা করছি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.