প্রয়োজন হলে তখন আমার শুভচিন্তার প্রতিফলন ঘটাব

0
85

কয়েক মাস আগেও রাজনীতির মাঠে-ময়দানে অনালোচিত মুখ ছিলেন নবনির্বাচিত মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। তিনিই এখন রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয়। গত ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
সাত মাস পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে থাকে। তবে দলীয় সরকার, না নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে– এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপিসহ কয়েকটি দল। ফলে পরিস্থিতির জটিলতা আছে। অভিভাবকস্বরূপ রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কী হবে– এদিকেও নজর এখন দেশবাসীর।

এ বিষয়ক প্রশ্নে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, সংবিধানের নিরাপত্তা বিধানই আমার মূল লক্ষ্য। গণতন্ত্র আছে; দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে যদি কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে সংবিধানের আলোকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রয়োজন হলে তখন আমার শুভচিন্তার প্রতিফলন ঘটাব।’

গত ২৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর কোনো গণমাধ্যমকে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের এটিই প্রথম সাক্ষাৎকার। ৩০ এপ্রিল বঙ্গভবনে সমকালকে তিনি সোয়া দুই ঘণ্টার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন।

সমকাল: সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। কেমন আছেন? রাষ্ট্রপতি হিসেবে নতুন দায়িত্ব কেমন লাগছে?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: ভালো আছি। আগেও অনেক দায়িত্ব পালন করেছি। তবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটা একটু ব্যতিক্রম। তবুও এটা আনন্দদায়ক মনে হচ্ছে।

সমকাল: ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন। কর্মজীবনে সাংবাদিক, বিচারক, দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার এবং সবশেষ একটি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এখন রাষ্ট্রপতি। নতুন দায়িত্বটিকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন কিনা?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: জীবনের সব কিছুই চ্যালেঞ্জ। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। এটিই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করতে পেরেছি– এটাও আমার বড় সার্থকতা। সময় যা বলে তা-ই করতে হয় ন্যায়বিচারের স্বার্থে; ন্যয়সংগতভাবে অবস্থান রাখার স্বার্থে। তাই যখন যা প্রয়োজন সেটা করেছি; অন্তর দিয়ে করেছি।

সমকাল: কখনও ভেবেছিলেন– রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবেন? কখন জানলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আপনাকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করা হচ্ছে? তখনকার অনুভূতি জানতে চাই।

মোঃ সাহাবুদ্দিন: রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলে সাধারণ পাঠক হিসেবে আমিও কৌতূহলবশত সেই সংবাদগুলো পড়েছিলাম। কখনও ভাবি নাই– আমার নাম আসবে। কল্পনার অতীত; স্বপ্নেরও অতীত। আগামী নির্বাচনে পাবনা-৫ আসনে নির্বাচন করব– এমনটা মন স্থির করেছিলাম আগেই। আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে মনোনয়ন চাইব; পেলেও পেতে পারি– এটাই ছিল আমার ভাবনা। কিন্তু হঠাৎই, সম্ভবত রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নপত্র দাখিলের তিন দিন আগে স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে কীভাবে ফরম পাব; পূরণ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়েও ধারণা দেন। আবার সভাপতি এটাও বলেছিলেন– ‘তুমি এটা ডিসক্লোজ করো না।’
আমার ওপর তো আকাশ ভেঙে পড়ল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিস্মিত হওয়ার চরম পর্যায়ে। এর মধ্যে সভাপতি আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক প্রসেস যেটা আছে, সেটাও অনুসরণ করেছেন। আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় সভাপতি দল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নাম আহ্বান করেন। কিন্তু সেখানে সভাপতিকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কেউ কেউ বলেন, প্রধানমন্ত্রী এককভাবে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করেছেন। কিন্তু আমি বলব, পার্লামেন্টারি বোর্ড যদি সভাপতিকে দায়িত্ব দেয় তাহলে সেটাও তো একটা গণতান্ত্রিক প্রসেস।

সমকাল: আপনি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি আপনাকে এখনও আলোড়িত করে বা অনুপ্রেরণা জোগায়?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবার অনুপ্রেরণা। তাঁর অনুপ্রেরণায় যুদ্ধ করেছি। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি। দু’বার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি ঘটনাচক্রে। দুটোই সীমান্ত এলাকায়। ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ আমরা ১০ জনের গ্রুপ ছিলাম। তখন দু’জন শহীদ হয়েছেন।

সমকাল: রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আপনার শৈশবের কথা জানতেও দেশবাসী আগ্রহী হতে পারে।

মোঃ সাহাবুদ্দিন: আমার জন্ম পাবনা শহরে। আমরা চার ভাই, ছয় বোন। ১০ ভাইবোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। খুব ডানপিটে টাইপের ছিলাম। তবে ছাত্র খারাপ ছিলাম না। একটি ট্রাঙ্কে বই-খাতা নিতাম, তাতে অ্যালুমিনিয়ামের একটি বক্সে ডিম, পরোটা, হালুয়া ইত্যাদি দুপুরের টিফিন আম্মা দিয়ে দিতেন। স্কুলে আমার চেয়েও দুষ্টু বন্ধুরা খাবারগুলো খেয়ে নিয়ে কিছু রেখে দিত। আমি সেটা এনজয় করতাম। মা জিজ্ঞেস করতেন, দুপুরে খেয়েছিস? আমি বলতাম, মা খাইছি। কিন্তু মা বলতেন, তোর মুখ শুকনো কেন ইত্যাদি। শৈশবের এটা খুব মনে পড়ে।
আরেকটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে প্রতিবেশীদের আমগাছে উঠে পড়ে গিয়ে ডান হাত মচকে ও ভেঙে যাওয়ায় ডাক্তাররা প্লাস্টার করে দেন। পরীক্ষার ২০-২৫ দিন বাকি। প্রতিবেশী আব্দুর রব বগা মিয়ার মেয়েসহ প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে দেখতে আসে। তাদের মধ্যে পরের বছরের পরীক্ষার্থী কয়েকজন মজা করে বলে, ‘খুব ভালো হয়েছে। একসঙ্গে পরের বছর পরীক্ষা দেব। ঠিকই সাজা হইছে। এক বছর আগেই পাস করবি তুই, দেখ মজা।’ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পরীক্ষার আগেই আমার হাতের প্লাস্টার কাটা হয় এবং ১৯৬৬ সালেই পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছিলাম।

সমকাল: রাজনীতিতে কীভাবে জড়ালেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রচারের জন্য পাবনায় আসেন। দুপুরে বঙ্গবন্ধু পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বগা মিয়ার বাসায় খাবার খান ও জোহরের নামাজ আদায় করেন। বগা চাচার পাশের বাসাই আমাদের। দেখি বগা চাচার বাড়ির সামনে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি উৎসুক হয়ে বাড়ির ভেতরে গেলাম। মাত্র এসএসসি পাস করেছি। কলেজে ভর্তি হব। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ অনেকেই তাদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য ফরম নিয়ে এসেছিল। আমি তখনও কোনোটিরই সদস্য হইনি। বগা চাচা আমাকে এবং নূরকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ব্যস্ত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বললেন, আয় মাঠে আয়। মাঠে গিয়ে জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। মনে হলো, বঙ্গবন্ধু সত্যই বলছেন, পাকিস্তানিরা আমাদের শোষণ করছে। এর পরই ছাত্রলীগের ফরম পূরণ করে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। নূর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

সমকাল: বঙ্গবন্ধুর আমলের রাজনীতি এবং বর্তমান রাজনীতি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: এককথায় বলব, আমরা ত্যাগের রাজনীতি করেছি। আদর্শের রাজনীতি করেছি। সেই আদর্শ হলো, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন করা। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ছাত্রলীগের উপদেষ্টা। তিনি ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফিরিয়ে নিতে শতভাগ চেষ্টা করছেন। বারবার তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ত্যাগের রাজনীতি করার জন্য বলছেন। তাতে অধিকাংশই ত্যাগের রাজনীতি করছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন থাকার কারণেই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক, কেউ কেউ এর মধ্যে ভোগের রাজনীতি করছেন। এটা আগে ছিল না।

সমকাল: ছাত্র ছাড়া মূলধারার রাজনীতিবিদরা?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: আমার ধারণা মিশ্র। অধিকাংশই ত্যাগের রাজনীতি করছেন। নয়তো দলীয় রাজনীতি বিস্তৃত হতো না। তবে পরিস্থিতি নেতা সৃষ্টি করে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের জায়গায় আস্তে আস্তে কনিষ্ঠ ও তরুণরা আসবেন। এখানে আওয়ামী লীগের কথা যদি বলেন, সেখানে নেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ দলটির নেতাকর্মীরা বাস্তবায়ন করছেন। অন্য দলের অনেকেই আদর্শের রাজনীতি করেন, তাঁরা বড় দল না হলেও। বামধারার অনেক দলের নেতা আছেন এমন। আর দু-একটা দলের কথা যদি বলেন তাহলে তাদের আদর্শ যে কী সেটাই বোধগম্য নয়। কারণ, তাদের সৃষ্টিই পরিষ্কার নয়।

সমকাল: ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আপনি দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ ছিলেন। কোনো স্মৃতি এখনও আপনাকে তাড়িত করে কিনা?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম। তখন আরও অনেকের সঙ্গে আমাকেও জেলে নেওয়া হয়। আমি মেনে নিয়েছি, বঙ্গবন্ধু যেখানে নেই, তাও আমি জীবিত আছি। একদিন মধ্যরাতে পাবনা কারাগার থেকে গাড়িতে করে ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাবনায় তখনকার সামরিক প্রশাসক ক্যাপ্টেন ফজলু, একজন মেজর, পিএসপি কংস ধর তরফদারসহ কয়েকজন প্রায়ই রাতের বেলা আমাকে জোর করে চোখ বেঁধে নিয়ে যেত তাদের ক্যাম্পে। অমানুষিক নির্যাতন করত। দু’দিন পর কারাগারে ফিরিয়ে দিত। এক সপ্তাহ পর আবার নিয়ে যেত। এটা চলছিল প্রায় আড়াই মাস। তখন একদিন রাত ১২টা-১টার দিকে পাবনা কারাগার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আমাকে এবং ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুকে (২০২০ সালে মারা যান) আলাদা গাড়িতে করে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হয়। কালেমা, সুরা যা আছে পড়তে বলা হলো। হঠাৎ গুলির আওয়াজ আসে, কীভাবে যেন শুয়ে পড়েছিলাম। পরে দেখি আহত হইনি। যারা গুলি করেছিল, তারা হাসাহাসি করল। মাটি থেকে দাঁড় করিয়ে তারা আমার চোখ খুলে দেয় এবং জানতে চায় কার বা কাদের নির্দেশে প্রতিরোধ আন্দোলন হচ্ছে। যা হোক যা বলার বলেছি। কিছু দূরে ডিলু ভাইয়ের কথাও কানে এলো। তারও একই অবস্থা। পরে আবার তারা আমাদের পাবনা কারাগার নিয়ে আসে। তখন মনে হয়েছিল, ভয় দেখানোর জন্য এটা করা হয়েছিল। কিন্তু যখন জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়, তখন থেকে ভয় প্রকট হতে থাকে। পাবনা থেকে পরে রংপুর কারাগারে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন এভাবে জেল-জুলম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।

সমকাল: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার কোনো স্মৃতি এখনও জাগরূক হয়ে আছে?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক স্মৃতি আছে। ১৯৭২ সালের একটি ঘটনা বিশেষভাবে স্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু ফেব্রুয়ারির ১৮ বা ২৮ তারিখে পাবনার নগরবাড়ীতে মুজিব বাঁধ উদ্বোধনের জন্য আসেন। বঙ্গবন্ধু সবে ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। অনুষ্ঠানে আমি পাবনা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি হিসেবে স্বাগত বক্তব্য দিয়েছি। অনুষ্ঠানেই একবার বঙ্গবন্ধু আমার চুল পেছন থেকে ধরে বলেছিলেন, ‘তুই তো ভালোই বলিস।’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরে মিটিং শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠবেন, তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বঙ্গবন্ধু ঘুরে বললেন, হেলিকপ্টারে উঠবি। আমি মনে করলাম, আমার পাশে দাঁড়ানো পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বগা মিয়াকে বলছেন। কিন্তু বগা চাচা তখন আমাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে ইঙ্গিত দিলেন। বললেন, ‘তোর সাথে।’ বঙ্গবন্ধু এবার বললেন, ‘ঢাকা যাবি।’ আমার পাশে তখন ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। তিনি বললেন, চল তোকে ঢাকা নিয়ে যাই। আমি চট করে বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টারে উঠে গেলাম। ঢাকায় পুরোনো বিমানবন্দরে নামার পর বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে বললেন, এই ক্যাপ্টেন, ওরে বাসায় নিয়ে যা, খাওয়ায়-দাওয়ায় কাউকে দিয়ে পাবনায় পাঠিয়ে দিস। এই স্মৃতি তো অম্লান।

সমকাল: যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: বঙ্গবন্ধু এ দেশে বাকশাল গঠন করেছিলেন, যাতে মানুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য না থাকে। এ কারণেই পুঁজিবাদী শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তার পর স্বাধীনতার মূল্যবোধ নষ্ট হয়। পাকিস্তানি ধারায় এ দেশকে চালানোর চেষ্টা চলে। অনেক কিছুই ঘটেছে। যদি এই ১৪ বছর ধারাবাহিকভাবে দেশ না চলত, তাহলে উন্নয়ন-অগগ্রতি হতো না। এখন মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। এটা স্বীকার করতে হবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে ওঠে। আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন ভোগের রাজনীতিতে জড়িয়ে না যায়। গণতন্ত্র আছে, দেশে নির্বাচন হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। যারাই আসকু, তারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন, এটাই জাতি ও আমার প্রত্যাশা।

সমকাল: দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: সবার ভূমিকা হওয়া উচিত নিজের এলাকার উন্নয়ন। জাতিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন। স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এখন আমাদের ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বে ওঠার ব্যবস্থা করা সব জনপ্রতিনিধির কতর্ব্য হওয়া উচিত, নিজেদের জন্য নয়। আর আমলাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু যা বলে গেছেন তার বাস্তবায়নই কাম্য।

সমকাল: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজন দেখছেন কিনা; যদি সংলাপের প্রয়োজন হয় তাহলে আপনার ভূমিকা কী হতে পারে?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: সংলাপ আগে হয়েছে। সমঝোতার বিষয়ে যদি কোনো পরিস্থিতি দেখা দেয়, তখন সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশন আছে, যেটা স্বাধীন। এই প্রথম আইনের আলোকে এই কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংবিধান অনুযায়ী আমাদের নির্বাচন হবে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের পরিবেশ থাকা উচিত। যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন এবং জনগণের রায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। আমি যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিই, সেখানে একটি শব্দ প্রণিধানযোগ্য, বিরাট! যেটা হলো, আমি সংবিধানের নিরাপত্তা বিধান করিব। এটাই চূড়ান্ত। আমি রক্ষক, সমর্থক, এটা বাই উইল, অর্থাৎ নিজের জন্য। কিন্তু সংবিধানের নিরাপত্তা বিধান করিব, অর্থাৎ এই সংবিধান যেন কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে। এই অবলিগেশনে আমি অবলিকেটড। কাজেই এই সংবিধানের বাইরে কোনো কিছু হোক, এটা আমি চাই না। তবে কোনো পরিস্থিতি যদি হয়, সেটাও আমাকে সংবিধান অনুযায়ী করতে হবে। প্রয়োজন হলে তখন আমার শুভচিন্তার প্রতিফলন ঘটাব। সংবিধানের নিরাপত্তা বিধানই আমার মূল লক্ষ্য।

সমকাল: বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। এই দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাই।

মোঃ সাহাবুদ্দিন: একসময় যৌক্তিকতা ছিল। প্রয়োজনের তাগিদেই আইন করা হয়। এরশাদ সরকারের আমলে অটোক্রেসি এত বেশি হয়েছিল, সারা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তখন জাতির ম্যান্ডেটের ওপর (গণভোট) একটি সিস্টেমে যেতে হয়েছিল, সেটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। সংবিধানের ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদে এটি সংযুক্ত হয়। কিন্তু পরে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে এটা বাতিল হয়েছে। কারণ, এই পদ্ধতি ছিল অনির্বাচিত। এটি কখনোই গণতন্ত্র সমর্থন করে না। উচ্চ আদালতের রায়ের পর এটি নিয়ে আর বিতর্ক চলে না।

সমকাল: ১৯৮০ সাল থেকে আপনি দুই বছর অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতাকে কীভাবে দেখছেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: আমি পাবনা জেলার সাংবাদিক ছিলাম। মফস্বলের খবর পাঠাতাম। এখন সারাদেশের খবর দেখছি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। সাংবাদিকরা সততা নিয়েই কাজ করছেন বলে বিশ্বাস করি। সাংবাদিকরা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয় বা নিজেদের প্রচার বাড়ানো বা নিজেই সেনসেশন তৈরি করে নিউজ বানাবেন না, এটাই প্রত্যাশা।

সমকাল: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: আশা করছি, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, গণতন্ত্রের নীতি সমুন্নত থাকবে এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ভালোই হবে। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যার যা দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে।

সমকাল: বঙ্গভবনে নতুন পরিবেশে আপনার পরিবারের সদস্যদের দিনগুলো কেমন কাটছে?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: বঙ্গভবনে আমার সঙ্গে স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা, আমাদের একমাত্র ছেলে, তার স্ত্রী ও তাদের দুই যমজ ছেলে আছে। পরিবারের সদস্যরা বঙ্গভবনে খুব এনজয় করছে তা বলা যাবে না। নিজেদের বদ্ধ মনে করে। তবে বাস্তবতা মানতেই হবে। আর আমি যখন নিজের দায়িত্বটাকে মনে করি, তখন বদ্ধ রয়েছি বলে মনে হয় না।

সমকাল: পাবনা আপনার জন্মভূমি। এলাকাবাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কবে যাচ্ছেন?

মোঃ সাহাবুদ্দিন: আমার নাম ঘোষাণার পরপরই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় আনন্দ মিছিল করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। এটা আমার সৌভাগ্য। আমি যেন তাদের ঋণ শোধ করতে পারি– এটাই লক্ষ্য। এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই। এ ক্ষেত্রে আমার অনুকরণীয় হলেন পূর্ববর্তী মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আগামী ১৫ মে পাবনায় যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।

সমকাল: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সময় দেওয়ার জন্য।

মোঃ সাহাবুদ্দিন: সমকালকে আমার শুভেচ্ছা। আপনিও ভালো থাকবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.