বুয়েটে রাজনীতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি শিক্ষার্থীদের

0
129
বুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

‘প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, বুয়েটকে নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বপ্ন ও পলিসি বাস্তবায়ন করুন। বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও। কারণ সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি।’ এভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠিতে আরজি জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুই দফায় বুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে দেড় হাজার শব্দের দীর্ঘ এই চিঠি পাঠ করেন তারা।

গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ নেতাকর্মীদের বুয়েট ক্যাম্পাসে জনসমাগম করাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার নাটকীয়ভাবে মোড় নেয় ঘটনা, ছাত্রলীগের সদস্য বুয়েট ছাত্র ইমতিয়াজ রাব্বির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররাজনীতির নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে হাইকোর্ট। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি ফেরাতে একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ।

তবে বুয়েট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কোর্টে যাবে বুয়েট। প্রথাগত ছাত্ররাজনীতি চালু হবে না। তবে বুয়েট ক্যাম্পাসে ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইউকসু)’ প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে সেদিকে তারা এগোবেন।

চিঠিতে শিক্ষার্থীরা আরও উল্লেখ করেন, আমাদের অনুরোধ, আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন, ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই। আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দেব খুব শিগগিরই।

শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, বুয়েট করোনা, ‘পদ্মা সেতুসহ নানাভাবে দেশের জন্য অবদান রেখে চলেছে। অপেক্ষাকৃত কম অর্থে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে বিজয় ছিনিয়ে আনছেন।’

তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিভাবক। আমরা মেধা ও শ্রমের সবটুকু দিয়ে বিজ্ঞানের অবাক করা দুনিয়ার একটা অংশের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর।

ছাত্ররাজনীতির কারণে সাবেকুন্নাহার সনি, আরিফ রায়হান দ্বিপ সবশেষ আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা তুলে ধরে তারা উল্লেখ করেন, বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। এ ছাড়াও অসংখ্য শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিং কিংবা ছাত্ররাজনৈতিক দাপটের অমানুষিক নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা বুয়েটের র‍্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে।

তারা আরও উল্লেখ করেন, ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। একটি রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সারা দেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ব্যতীতও গত কয়েক বছরে সুস্থ নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সব উপাদান ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিল।

তারা আরও বলেন, ছাত্ররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জাতীয় মূল্যবোধ ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনেপ্রাণে ধারণ করে। দেশের গৌরবময় ইতিহাস, ত্যাগ-তিতিক্ষা আমরা অন্তরে লালন করি, ভবিষ্যতে পথচলায় অনুপ্রেরণা জোগায়। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা অবশ্যই যেকোনো প্রকারের সন্ত্রাস, মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ গোষ্ঠী থেকে নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর।

আন্দোলনকারীরা আরও উল্লেখ করেন, আমাদের ছোট ভাই-বোনেরা আরও একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চায় না। আমাদের ভিসি এবং আমাদের সব শিক্ষকের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা জানি, তারা তাদের সন্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে অনুরোধ আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সব সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি, এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।

শিক্ষার্থীরা খোলা চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, আমাদের চাওয়া, বুয়েটকে ঘিরে আমাদের জাতির জনকের যে ভিশন ছিল, তা বাস্তবায়ন করা হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন বুয়েটের প্রকৃতি ভিন্ন। তাই তিনি নিজে রাজনীতির আওতা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরে রেখেছিলেন। আজ যখন তারই গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বুয়েটের মতো বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যেকোনো মূল্যে রাজনীতির আওতায় আনার কথা বলে, আমরা বিশ্বাস করি তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও সিদ্ধান্তকে অপমান করা হয়। আমাদের এই পথচলা আপনিই (প্রধানমন্ত্রী) নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন। সেই আশাতেই এই চিঠি। আমরা, আপনার হাজারো সন্তান আপনার সহযোগিতার প্রতীক্ষায় আছি।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে একগুচ্ছ কর্মসূচি ছাত্রলীগের

মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বীর আবাসিক হল ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বুয়েট শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি। নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতামত আহ্বান ও আলোচনা। সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গি কালোছায়া থেকে বুয়েটকে মুক্ত করতে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন। বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা।

সাদ্দাম বলেন, তারিখগুলো আমরা পরবর্তী সময়ে জানিয়ে দেব। যেহেতু বুয়েটে পরীক্ষা চলছে। তাদের একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এ ধরনের কর্মসূচি ছাত্রলীগ গ্রহণ করবে না। কর্মসূচি এমন সময় পালন করব, যেন বুয়েটের একাডেমিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালু থাকে।

তিনি বলেন, আমরা কোনো ধরনের তাড়াহুড়োর মধ্যে নেই। সাংগঠনিক কমিটি গঠন যতটা না আমাদের লক্ষ্য, তার চেয়ে বৃহত্তর লক্ষ্য ছাত্র রাজনীতি থেকে যেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ‍বিযুক্ত না থাকে।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় শুরু হবে। কিন্তু সেটি কোন ছাত্র রাজনীতি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এই রাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র‍্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি নয়। এই ছাত্র রাজনীতি হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়-সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.