বাজেটে শিক্ষাকে এত অবহেলা করে কী লাভ হচ্ছে

0
111
মাহতাব উদ্দিন, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল

বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আমাকে প্রতিবার হতাশ করে। আমাদের শিক্ষায় সরকারি ব্যয় জিডিপির অনুপাতে কম করে হলেও ৪ শতাংশ হওয়া উচিত। মোট সরকারি ব্যয়ের অনুপাতে এটা হওয়া উচিত অন্ততপক্ষে ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ বাজেটের ১৫ শতাংশ। এই মানদণ্ড আমার ঠিক করা নয়, ইউনেসকোর।

ইউনেসকোর দ্য এডুকেশন ২০৩০ ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যাকশনে দুটি মানদণ্ডকে ‘গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করেছে—শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ থেকে থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ করা এবং/অথবা শিক্ষায় সরকারি ব্যয়ের কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা। বলা বাহুল্য, আমরা বরাবরই এ দুই ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি। খালি পিছিয়ে আছি বললে ভুল হবে, পুরো পৃথিবীতে এ দুই মানদণ্ডে আমাদের অবস্থান একেবারে শেষের দিকে।

খালি কথায় চিড়ে ভেজে না। তাই ‘চাক্ষুষ’ বোধগম্যের জন্য বিশ্বব্যাংকের ডেটা ঘেঁটে ২০১৯ ও ২০২১ সালের জন্য দুটি চিত্রলেখ তৈরি করেছি। (২০২১ সালের পর ডেটা নেই, আর কোভিডের বিবেচনায় ২০১৯ হলো সবচেয়ে কাছাকাছি সবচেয়ে স্বাভাবিক বছর)। দুটি চিত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান যে পরিষ্কারভাবে তলানিতে, তা পরিষ্কার।

২০১৯ সালের ডেটা (কারণ ২০১৯ সালের ডেটা সবচেয়ে বেশি দেশের জন্য পাওয়া যায়) অনুসারে, বাংলাদেশের থেকে যেসব দেশ জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় কম ব্যয় করে, তার মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা, অ্যাঙ্গোলা, বারমুডা, গিনি, মৌরিতানিয়া, হাইতি, ভানুয়াতু, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, উগান্ডা, মোনাকো ও সোমালিয়া। শ্রীলঙ্কা বাদে তালিকার এই একটা দেশের সঙ্গেও কি আমাদের তুলনা চলে? না করা উচিত?

জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় আমাদের ব্যয় মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশের মতো, আর সরকারি ব্যয়ের মাত্র সাড়ে ১১ শতাংশ। এ বছরের বাজেটেও ঠিক একই আনুপাতিক বরাদ্দ। আমরা যে ভিয়েতনামের সঙ্গে সব সময় সবকিছু তুলনা করতে চাই, সেই ভিয়েতনামের শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে ৪ শতাংশ, আর সরকারি ব্যয়ের অনুপাতে প্রায় ১৫ শতাংশ—ঠিক যেটা ইউনেসকোর দেওয়া ক্রিটিক্যাল রেফারেন্স পয়েন্ট। ভিয়েতনামের উন্নয়ন এমনি এমনি হয়নি বা হচ্ছে না।

বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোয় প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, এই বিষয়ে দ্বিমত নেই, দ্বিমত করার অবকাশও নেই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে একটা গুণগত পরিবর্তন দরকার, সেটা হয়নি। অন্য কোনো ক্ষেত্রের চেয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই কথা বেশি খাটে। আমাদের বাজেট বক্তৃতায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের কথা থাকে, কিন্তু মাল্টিমিডিয়া ক্লাস যিনি নেবেন, সেই শিক্ষকেরও গুণগত পরিবর্তন ও প্রশিক্ষণ দরকার—এ বিষয়ে বরাবরই উদাসীনতা থাকে।

আজকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের যে অবস্থা, সেই বেতন দিয়ে কতজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হতে অনুপ্রাণিত করা যাবে? কয়টা স্কুলে বা কলেজে গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলার ভালো শিক্ষক আছেন? কয়টা স্কুলে বা কলেজে নিয়মিত বিজ্ঞানের বা গণিতের ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া হয়?

ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য বাজেট যেমন লাগে, বাজেটের পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও লাগে। সেই প্রশিক্ষণের জন্যও বাজেট লাগে। আর সেই বাজেট এই বাজেটে কতটুকু আছে, জানা নেই। কিন্তু পরিমাণটা যে অপ্রতুল, এটা বোঝাই যায়। বোঝা যায়, বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর ক্রমাগত মান অবক্ষয় দেখে।

দেশের সব জেলার ‘জিলা স্কুল’গুলো একসময় স্বনামধন্য ছিল। এখনো হয়তো তারা সেরা। কিন্তু এই জিলা স্কুলগুলোর বাইরে অন্য স্কুলগুলোর কী দশা, এটা অবশ্যই সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। একটা ছোট্ট তথ্য দিই। ২০১৯ সালে ইউনিসেফ দেশব্যাপী একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপের তথ্যানুসারে, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে—এ রকম শিশুদের মাত্র ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশের শ্রেণি সাপেক্ষে মৌলিক গণিতে যতটুকু দক্ষতা থাকা দরকার (যেটাকে অনেকে বলবেন ‘বেসিক জ্ঞান’), তা আছে। অন্যদের নেই।

মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে এই হার ৫৯ দশমিক ৫। নিম্নমাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিকের গড়ে এই বিরাট উল্লম্ফন দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই, এর কারণ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া। যারা নিম্নমাধ্যমিকে কুলোতে পারেনি বা তাল মেলাতে পারেনি, তাদের একটা বড় অংশ ঝরে পড়ে গেছে। আর তাই শতাংশের হারে এই পরিবর্তন (৪৭ থেকে ৫৯), তবুও মাধ্যমিকের ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শ্রেণি সাপেক্ষে গণিতের যে ন্যূনতম দক্ষতা থাকা দরকার, তা নেই। এই পরিসংখ্যান ভয় জাগানো।

আজ শিক্ষাব্যবস্থার এ পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। সেই ১৯৮০ সাল থেকে এখন অবধি কোনো দিনই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মোট ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশের ওপরে ছিল না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অবহেলার ফল শুধু যে কারিগরি অদক্ষতা নয়, বরং নৈতিক অবক্ষয়ও। আজকে অনেক কিশোর যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তার একটা বড় কারণ শিক্ষা খাতকে এই যুগ যুগ ধরে অবহেলা।

এই অদক্ষ শ্রমশক্তি নিয়ে টেকসই উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান, বিশেষ করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাপেক্ষে। তাই আমার মনে হয়, আমাদের বাজেটে এই বাস্তবতার প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠা অসম্ভব জরুরি। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ একলাফে জিডিপির ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে যাওয়া যাবে না। কিন্তু বাজেটের ১১ শতাংশ থেকে এটাকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করতেই হবে।

শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কমিয়ে অন্য খাতে না দিয়ে অন্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে হলেও শিক্ষা খাতে দিন। এর ফল এক দিনে না পাওয়া গেলেও এক দশকের মধ্যে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। মোটকথা, শিক্ষার বিকল্প নেই। বাজেটেও এই প্রতিফলন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি জরুরি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.