সাম্প্রতিককালে মুক্তি পাওয়া কোরিয়ান সিরিজগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছে রেট্রো ঘরানা। ইতিহাস নয়তো অতীতের পটভূমি উঠে আসছে মুক্তি পাওয়া সিরিজগুলোতে। পুরোনো দিনের এসব গল্প যেমন অনেকের ছোটবেলার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনছে, তেমনি এ প্রজন্মের কাছেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া এমন কয়েকটি সিরিজ ‘আ হানড্রেড মেমরিজ’, ‘এমা’, ‘বিয়ন্ড দ্য বার’ এবং কিছুদিন আগে শেষ হওয়া সিরিজ ‘লো লাইফ’—এই সব কটিতে দেখানো হয়েছে কয়েক দশক আগের গল্প। এই সিরিজগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছে রেট্রো মানেই তা পুরোনো দিনের দর্শককে আকৃষ্ট করবে তা নয়, বরং সব বয়সী দর্শকের কাছেই জনপ্রিয়তা পেতে পারে এ ধারার গল্প।

কেন প্রভাব ফেলছে রেট্রো
দর্শকের মধ্যে যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁরা সব সময়ই সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করতে চান। আর যখন পর্দায় সে সময়ের চিত্র ভেসে ওঠে, তখন তা তাঁদের কাছে হয়ে ওঠে পুরোনো দিনকে ফিরে পাওয়ার এক মোক্ষম উপায়। আর যাঁরা সে সময় দেখেননি, তাঁদের কাছে সেই সময়ের উপস্থাপন নতুন ও আকর্ষণীয় মনে হয়। যেমন কোরিয়ান সিরিজে ৯০ দশকের পটভূমি দেখাতে ব্যবহৃত হয় পেজার, পাবলিক ফোন বুথ, ক্যাসেট টেপ, ৩৫ মিমি ক্যামেরা। নব্বইয়ের দশকে বড় হওয়া দর্শকেরা মুর্হূতের মধ্যে এই উপাদানগুলোর সঙ্গে নিজেদের শৈশব কিংবা কৈশোর মেলাতে পারেন।
১৯৮০-এর দশকের একটি সাধারণ গলি বা পরিবারের সবাই মিলে খাবার খাওয়ার মতো নস্টালজিক উপাদানগুলো আরামদায়ক অনুভূতি দেয়; যা আধুনিক জীবনের চাপ থেকে মুক্তি দেয়। বিশেষ করে মধ্যবয়সী দর্শকেরা তাঁদের অতীত জীবনের এসব ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পান। এসব এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের সূচনা বা পরিবর্তনের উত্থান–পতন নিয়ে কথোপকথন বা বিশ্লেষণকে উৎসাহিত করে। যেমন এক দশক আগে মুক্তি পাওয়া ড্রামা ‘রিপ্লে ১৯৮৮’। এটি আশির দশকের সিউল শহরের চারটি পরিবার ও তাদের আশপাশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে। এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিকে চেনানোর মাধ্যম
আজকের দিনে সিনেমা হোক কিংবা সিরিজ, প্রতিটি কনটেন্টকে দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ কনটেন্ট বাজারে প্রযোজকেরা গল্পকে স্বতন্ত্র করার জন্য রেট্রোকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছেন। আধুনিক ড্রামা যা অনেক কনটেন্টের ভিড়ে আলাদা হয়ে ওঠা কঠিন, রেট্রো-ধারা সেগুলোকে নতুন মাত্রা এনে দিচ্ছে। যেমন রেট্রো সংগীত, ফ্যাশন এবং সামাজিক পরিবেশকে গল্পে যুক্ত করতে পারলে তা দর্শকদের মাত করে রাখছে।
রেট্রো থিম বিভিন্ন বয়সের দর্শককে একত্র করে, যা স্ট্রিমিং যুগে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বদৌলতে সব দেশের দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে কনটেন্টগুলো। তাই সেগুলো সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠেছে ‘বর্ডারলেস’। তাই নিজ দেশ বা নিজ ভাষার লোকের বাইরেও কনটেন্টগুলোকে দর্শককে আকৃষ্ট করতে হয়। এ ছাড়া কোরিয়ার রয়েছে অনন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি, যা কনটেন্টে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তাই আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য সিউলের ১৯৮০-এর দশকের রাস্তাগুলো সাংস্কৃতিক আবিষ্কার অনুভূতি এনে দেয়। ফলে তা কে–ড্রামা দেখার অভিজ্ঞতায় নতুনত্ব যোগ করে।
রয়েছে চ্যালেঞ্জও
তবে রেট্রো ড্রামাগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব রেট্রো ড্রামা সমান সফল হয় না। শুধু পুরোনো দিনের স্মৃতিনির্ভর ড্রামা দেখালে দর্শকেরা ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন। প্রযোজকদের উচিত নস্টালজিয়ার সঙ্গে আধুনিক থিমও মিশানো, যাতে গল্পগুলো প্রাসঙ্গিকতা না হারায়।
সাম্প্রতিক আলোচিত দুই সিরিজ
পুরোনো দিনের গল্প বলে মাত করেছে সাম্প্রতিক দুই কোরীয় সিরিজ ‘এমা’ ও ‘বন অ্যাপাটিট, ইয়োর ম্যাজেস্টি’। ‘এমা’র অনেক ঘটনাই ঘটেছে চুংমুরোতে; এটি সিউলের কেন্দ্রীয় এক সড়ক, যা কোরিয়ান চলচ্চিত্রশিল্পের ঐতিহাসিক কেন্দ্র। কফিশপ, রেস্তোরাঁ, ক্যামেরার দোকান আর ছাপাখানায় সরব ছিল এই অঞ্চল। এখানেই ১৯০৭ সালে গড়ে ওঠে দানসুংসা-কোরিয়ার প্রথম সিনেমা হল। নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্রায়ণ আর নতুন ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থাগুলো গ্যাংনাম এলাকায় চলে গেলেও আজও ‘চুংমুরো’ শব্দটা কোরিয়ান সিনেমার প্রতিশব্দ।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কোরিয়ার সামরিক শাসক ছিলেন চুন দু-হুয়ান। ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে নির্মমভাবে গওয়াংজু হত্যাযজ্ঞ ঘটান, যেখানে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হন। একদিকে সহিংস দমননীতি, অন্যদিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য চালু করেন তথাকথিত ‘৩এস’ নীতি—সেক্স, স্ক্রিন আর স্পোর্টস। এর ফলে কোরিয়ায় জন্ম নেয় ইরোটিক চলচ্চিত্রের নতুন ধারা। ‘মাদাম এমা’ ছিল সেই নীতির আওতায় তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র। কোরিয়ায় প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা তৈরির গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘এমা’। নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর রেট্রো থিমের এ সিরিজও বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছে।
অন্যদিকে প্রেম, ইতিহাস আর কল্পনার মিশেলে তৈরি ‘বন অ্যাপাটিট, ইয়োর ম্যাজেস্টি’ সিরিজটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন তুমুল আলোচনা। তবে খুব কম দর্শকই জানেন গল্পটির মূল উৎস; কোরিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসকদের একজনের জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই সিরিজ!

১৪৯৪ থেকে ১৫০৬ সাল পর্যন্ত কোরিয়া শাসন করেছিলেন ইয়নসানগুন। শৈশবেই জীবনের অন্ধকার দিকের মুখোমুখি হন। তাঁর জন্মদাত্রী মা রানি ইউনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়; পরে বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘদিন তিনি ভেবেছিলেন সৎমা রানি জংহিয়নই তাঁর মা। সত্য জানার পরই বদলে যান ইয়নসানগুন।
ক্ষমতায় আসার পর মায়ের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান, কিন্তু বিরোধিতার মুখে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেন, নিজ হাতেও অনেককে হত্যা করেন; এমনটাও শোনা যায়। তাঁর নিষ্ঠুরতা এরপর ধীরে ধীরে আরও বেড়ে যায়। তিনি শিক্ষার সুযোগ বন্ধ করে দেন, রাজকীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভোগবিলাসের ক্ষেত্রে পরিণত করেন। জনগণ তাঁকে হানগুল ভাষায় সমালোচনা করলে ভাষাটিই নিষিদ্ধ করেন। তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য শত শত নারীকে অপহরণ করে প্রাসাদে আনা হতো। তিনি বৌদ্ধমন্দির বন্ধ করে দেন, প্রতিবাদীদের দমন করেন, শিক্ষিত ও প্রভাবশালী মানুষদেরও হত্যা করেন। ১২ বছরের শাসন শেষে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, নির্বাসনে পাঠানোর দুই মাস পর মারা যান এই শাসক।
সিরিজটিতে ঐতিহাসিক উপাদান থাকলেও এটি ইয়নসানগুনের বায়োপিক নয়; বরং ইতিহাসের ভয়ংকর এক অধ্যায়কে পটভূমিতে রেখে ভিন্নধর্মী এক প্রেমের কাহিনি। কোরিয়ান চলচ্চিত্রেও বারবার উঠে এসেছেন ইয়নসানগুন। ‘প্রিন্স ইয়নসান’, ‘দ্য কিং অ্যান্ড দ্য ক্লাউন’ ইত্যাদি সিনেমায়ও উঠে এসেছে তাঁর শাসনের ভয়াবহতা। ১২ পর্বের সিরিজটির প্রথম দুই পর্ব মুক্তি পেয়েছে ২৩ আগস্ট, শেষ পর্ব মুক্তি পাবে ২৮ সেপ্টেম্বর।
তথ্যসূত্র: কোরিয়া টাইমস, টাইম
পৃথা পারমিতা নাগ
ঢাকা