বিপাকে গরু ব্যবসায়ীরা লাভের টাকা নাকি ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকায় থাকা?

0
622
গরুর হাট।

প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগে রাজধানী ঢাকায় গরু আনেন ফারুক হোসেন। কুষ্টিয়ায় নিজের বাড়ি থেকে ফারুকের সঙ্গে তাঁর ভাই, ভগ্নিপতিরাও ট্রাকে করে গরু নিয়ে আসেন। এবার ফারুক ১৩টি গরু নিয়ে যাবেন পুরান ঢাকার নয়াবাজার পশুর হাটে। ঢাকায় এসব গরুর প্রত্যাশিত দাম পাওয়া নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন। আর গরু বিক্রির পর সুস্থ শরীরে কুষ্টিয়ার ফিরে যেতে পারবেন কি না, সেই ভাবনায় কপালে ভাঁজ পড়েছে তাঁর। কারণ, রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বড় আইলচাড়া ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা গ্রামের গৃহস্থ ফারুক হোসেন বলেন, ‘এবারের মতো পরিস্থিতি আগে কখনো কোরবানির ঈদের আগে হয়নি। জানুয়ারি মাস থেকে ৫৫ কেজি ভুসির বস্তা ১ হাজার ৩০০ টাকা বেড়ে এখন হয়েছে ২ হাজার টাকা। গরুর খাবারের টাকায় গাভির দুধ বিক্রি করে আসত। অ্যান্টিবায়োটিক আতঙ্কে এক মাস ধরে দুধ বিক্রি কমে গেছে। গরু লালনপালনের খরচও বেড়েছে। এখন ঢাকায় ডেঙ্গুর কথা শোনা যাচ্ছে। তাই গরুর দাম পাওয়া নিয়ে চিন্তায় আর ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্কে আছি।’

উত্তরাঞ্চলের গৃহস্থরা বন্যার কারণে গরুর দাম নিয়ে আশা-নিরাশায় রয়েছেন। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার গৃহস্থদের বাড়িঘর কয়েক বছর ধরে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠত। এই উপজেলার ধানগড়া, ঘুড়কা, নলকা, চান্দাইকোনা ইউনিয়নের গ্রামগুলো গৃহস্থের এলাকা হিসেবে পরিচিত। কারণ, এখানে প্রচুর ধান হয়, আবার চাষাবাদের জন্য প্রতিটি বাড়িতেই কমপক্ষে দু-তিনটি গরু পালন করা হয়। অনেকে আবার কোরবানি ঈদের জন্য বাছুর কিনে বড় করেন। এই এলাকার বাসিন্দারা গরু রাজধানী ঢাকা বা অন্যান্য অঞ্চলে খুব একটা নিয়ে যান না। তাঁরা ব্যাপারীদের কাছে গরু বিক্রি করে থাকেন। কিন্তু এবার তাঁদের এলাকায় গরুর ব্যাপারীদের আনাগোনা নেই বললেই চলে।

ধানগড়া ইউনিয়নের লাহোর গ্রামের গৃহস্থ আজহার আলী ও আবদুস সালাম ভাবনায় রয়েছেন। ৩০ জুলাই আজহার আলী বলেন, ‘গত বছর কোরবানির ঈদের পরে তিনটি বাছুর কিনেছিলাম। প্রায় এক বছর ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে এগুলারে ভুসি খাইয়ে বড় করছি। এ ছাড়া আরও অনেক খরচ হইসে গরুগুলারে পালতে। এ বছর এখনো হাট জমেনি। কিন্তু হাটে প্রচুর গরুর আমদানি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে কী হবেক!’

ধানগড়া ইউনিয়নের নলছিয়া, জয়ানপুর গ্রামের আরও ১০ জন গৃহস্থ বললেন একই কথা। তাঁরা বলেন, কোরবানির ঈদ ঘিরে এ সময় বাড়িতে বাড়িতে গরু ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যেত। কিন্তু এবার এখনো সে রকম হচ্ছে না।

চান্দাইকোনা হাটের গরু ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলা থেকে হাটে প্রচুর গরু আসছে। বন্যাকবলিত এলাকার গৃহস্থরা তুলনামূলকভাবে একটু কম দামেই গরু বিক্রি করছেন। ফলে, স্থানীয় গৃহস্থদের গরু বিক্রি এখনো তেমন হচ্ছে না।

গরু ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষাকালে এবার হবে কোরবানির ঈদ। ঈদের আগে বৃষ্টি বেশি হলে হাটে গরু উঠবে কম। এর সঙ্গে যদি ভারতীয় গরু সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে থাকে, তাহলে আরও সর্বনাশ।

তবে দেশি গবাদিপশুতে কোরবানি ঈদের চাহিদা মিটবে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ঈদে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মোট সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ। এর মধ্যে কোরবানি হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। এবার এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ। এগুলোর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু ও মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য গবাদি রয়েছে। এর মধ্যে ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১৮ লাখ গবাদিপশুর মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ পশুর কোরবানি হতে পারে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় প্রায় আট লাখ গবাদিপশু বেশি রয়েছে।

তাই গবাদিপশুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কোরবানি ঈদের আগপর্যন্ত দেশের বাইরের গরু প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ১৬ জুলাই এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান জানান, ঈদুল আজহার পশুর সংখ্যা নিরূপণ, কোরবানির হাটবাজারে স্বাস্থ্যসম্মত পশুর কেনাবেচা ও স্বাস্থ্যসেবা, বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, পশুর গাড়ি ছিনতাই রোধ এবং দেশের পশুবিক্রেতাদের স্বার্থে ঈদুল আজহা পর্যন্ত সীমান্ত পথে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের গবাদির অনুপ্রবেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় জানানো হয়, দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পর থেকে ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। আগে প্রতিবছর ২৪-২৫ লাখ ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ ঘটলেও ২০১৮ সালে মাত্র ৯২ হাজার গরু দেশে ঢুকেছে।

চাহিদার তুলনায় কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু বেশি থাকায় কৃষকেরা প্রত্যাশিত দাম পাবেন কি না জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিজি হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, দাম নিয়ে সরকারের কিছু করার নেই। গবাদিপশুর দাম নিয়ন্ত্রণ হয় মার্কেটে। তবে বন্যার প্রভাব যেন গবাদিপশুর ওপর না পড়ে, সে জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় সর্বাত্মক সহায়তা করা হয়েছে। গবাদিপশু যেন টেকে, সে জন্য এবারই প্রথম বিনা মূল্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে খামারিসহ কৃষকদের গোখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয়েছে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আশা করছি ঈদের আগে পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে। তবে সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য শাখার সঙ্গে সার্বক্ষণিক লিয়াজোঁ রয়েছে। হাটগুলোতে কোরবানির পশু ওঠার আগে মশা মারার ওষুধ ছিটাতে সিটি করপোরেশনগুলোকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হাটগুলোতে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হবে।

তবে খামারি ও গরু ব্যবসায়ীরা জানান, পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে পশু বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক সময় মহাসড়ক ও সড়কে গরুবোঝাই ট্রাকগুলোকে জোর করে ইজারাদারের লোকজন তাদের হাটে নিয়ে যায়। এর প্রভাব কোরবানির বাজারে পড়ে।

ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো এবং চাঁদাবাজি বন্ধ হলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই উপকৃত হবেন। তবে এবার ডেঙ্গুর জন্য পশুর হাটগুলোতে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে করে মশা তাড়াতে হবে। হাটের পাশে ডোবা-নালায় প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার মশা মারার ওষুধ ছিটাতে হবে। এর জোগানও সিটি করপোরেশন, পৌরসভার পক্ষ থেকে সরবরাহ করা উচিত। হাট ইজারাদারদের এ জন্য পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.