জাহাঙ্গীরের ‘গুমের ভয়’

0
100
আজমত উল্লা খান, জাহাঙ্গীর আলম, সরকার শাহ্‌ নূর ইসলাম

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আলোচিত চরিত্র সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম অবশেষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘হয়তো কালকের পর আমার পায়ে শিকল পরাতে পারে, অ্যারেস্ট করতে পারে, গুমও করতে পারে। ষড়যন্ত্র করে না সরালে আমি নির্বাচন থেকে সরব না। যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনারা আমার মায়ের পাশে থাকবেন।’
এর আগে জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে তাঁর মনোনয়নপত্র রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলামের কাছে জমা দেন তিন সমর্থক। পরে জাহাঙ্গীর আলম নিজেই তাঁর মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র জমা দেন। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার ও পরে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ঘটনাটি ছিল গতকাল গাজীপুরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

এদিন মনোনয়নপত্র জমা দেন গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহ নূর ইসলাম (রনি সরকার)। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও রনি সরকারকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে বলে মনে করছেন অনেকেই। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর রনি সরকার বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছা ও আগ্রহে আমি প্রার্থী হয়েছি। নিজেদের আশা পূরণের জন্য জনগণই আমাকে নির্বাচিত করবেন।’

গতকাল নগরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খানসহ মোট ১২ প্রার্থী মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গতকাল শেষ দিনে দিয়েছেন ৮ জন। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করছে। মেয়র পদে দলটির কোনো পদধারী নেতা নেই। তবে ৫৭ সাধারণ ওয়ার্ডের অর্ধেকেরও বেশিতে দলটির পদধারী নেতারা প্রার্থী হয়েছেন।

দিনের শুরুতে আজমত উল্লা খান সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে মিলনায়তনে আসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল, গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক রাসেল সরকার, সিটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ প্রমুখ।
বিকেল ৩টার পর আসেন জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় কার্যালয়ের বাইরে তাঁর সমর্থকদের ভিড় দেখা গেছে। আগে থেকেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন ছিল। জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন মনোনয়নপত্র জমা দিতে নিজে আসেননি। জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, তাঁর মায়ের পক্ষে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, গাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হাজি আব্দুল কাদের, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল আলম আসকর।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী আগামী রোববার মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে। ৮ মে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর দিন ৯ মে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। আগামী ২৫ মে হবে ভোট।

আলোচনায় জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়ে ছিল নানা অনিশ্চয়তা। তবে জমা দেওয়ার পর এখন তিনি প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
গতকাল মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা এমনই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখেছি জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর মা নমিনেশন নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) প্রার্থী হিসেবে থাকবেন কিনা তা দেখার অপেক্ষায় আছি। তিনি (জাহাঙ্গীর) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন  চেয়েছিলেন। তাই বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি যদি তাঁর আস্থা থাকে,  দেশের উন্নয়নের প্রতি তাঁর আস্থা থাকে, তাহলে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।’

এদিকে জাহাঙ্গীর নিজেও শেষ পর্যন্ত প্রার্থী থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে সংশয় প্রকাশ করেন। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে বের হয়ে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে না সরালে আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে লড়তে চাই। এই নগরকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে কিছু লোক ধ্বংস করে দেবে। তারা ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। আমি পাঁচ বছরের জন্য মেয়র নির্বাচিত হয়েছি, এখনও কিন্তু পাঁচ বছর শেষ হয়নি। কাজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দায়িত্বশীল সবার কাছে অনুরোধ, আমাদের সহযোগিতা করুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রতি যে অন্যায়-অত্যাচার করা হয়েছে, সে জন্য মা পাশে দাঁড়িয়েছেন। সন্তান হিসেবে মাকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত  আছি। মা সবসময় এই নগরীর মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মেয়র হওয়ার পর মা দেখেছেন তাঁর সন্তানের ওপর কীভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। সে জন্য নির্বাচনে লড়ার কথা বলেছেন মা। মা এও বলেছেন, এই নগরীকে রক্ষা করতে হবে। তবে আমি আওয়ামী লীগে ছিলাম, আছি এবং থাকব। আমার কারণে দল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা দেখব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবন নাও থাকতে পারে। তবু আপনারা পাশে থাকুন। অনেকে মিথ্যাচার করতে পারে, আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে, অনেক কিছুই করতে পারে তারা। হয়তো আপনাদের সামনে আর নাও আসতে পারি, এ জন্য বলে যাই, এই নগরীকে রক্ষায় আমি এবং আমার সমর্থকদের পাশে থাকুন।’ জাহাঙ্গীর বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমি একা। আমার ওপর থেকে সব ধরনের ছায়া সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ছায়া, মায়ের ছায়া এবং নগরবাসীর ছায়া আমার ওপর আছে।’

বিএনপির মৌন সমর্থনের দাবি রনির
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি বলেছেন, ‘দল সিদ্ধান্ত না নিলেও এ নির্বাচনে আমরা কৌশল গ্রহণ করব।  হাসান সরকারের সেই কৌশলই কি তাঁর ভাতিজা রনি সরকারকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দেওয়া– এমন প্রশ্ন অনেকেরই।
বর্তমান সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিএনপির ঘোষণার মধ্যে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন প্রভাবশালী সরকার পরিবারের সন্তান রনি সরকার। আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাবন্দি নূরুল ইসলাম সরকারের ছেলে রনি বিএনপির মৌন সমর্থন নিয়েই নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন বলে মনে করছেন ভোটাররা।

অনেকে বলছেন, হাসান সরকারের কৌশলের অংশও এই রনিকে প্রার্থী করা। হাসান সরকারের সহোদর নূরুল ইসলাম সরকার ছিলেন নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনে বারবার আজমতের কাছে পরাজিত হয়েছেন নূরুল ইসলাম। এবার সিটি নির্বাচনে সেই নূরুল ইসলামের ছেলে রনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আজমত উল্লার সঙ্গে।
দল নির্বাচনে যাচ্ছে না কিন্তু আপনি প্রার্থী হয়েছেন; এ অবস্থায় ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য দলের কোনো চাপ আসছে কিনা– জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুক্ত থাকা রনি বলেন, ‘দলের  কোনো চাপের তো প্রশ্নই আসে না।  চাপ তো পাচ্ছিই না; বরং দল মৌন সমর্থন দিচ্ছে।’
গাজীপুরে বিএনপিতে সরকার পরিবারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ফলে এই পরিবারের কেউ প্রার্থী হলে তিনি নির্বাচনের মাঠ গরম করতে পারবেন বলে মনে করেন তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী। শেষ পর্যন্ত যদি জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনের মাঠে না থাকতে পারেন তাহলে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে রনির প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন স্থানীরা।

অন্য প্রার্থীরা
মেয়র পদে প্রার্থীর মধ্যে আরও রয়েছেন জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন, গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, জাকের পার্টির রাজু আহম্মেদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী মামুন মণ্ডল, হারুনুর রশীদ, অলিউর রহমান ও আবুল হোসেন।
রিটার্নিং অফিসার ফরিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, কাউন্সিলর পদের জন্য কেনা ৩৪৩টি মনোনয়নের মধ্যে ২৯০টি এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে বিক্রি হওয়া ৮৯টি মনোনয়নের মধ্যে জমা পড়েছে ৮২টি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.