আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে চায়। তার একটি হচ্ছে যত বেশিসংখ্যক সম্ভব ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, মেয়র পদে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াতে না দেওয়া। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে বলেছেন, তাঁদের এ দুটি বিষয় বা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভোটের পরিবেশ ঠিক থাকবে। দলীয় প্রার্থীর জয়ও সহজ হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সিটি করপোরেশনের ভোট হবে। স্বভাবতই এ ভোটে বিরোধী দল অংশ নিয়েছে কি না, সুষ্ঠু ভোট হলো কি না, ভোটারের উপস্থিতি কেমন ছিল—এসব বিষয় আলোচনায় আসবে। বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে মানুষকে ভোটমুখী করাও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।
বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটারের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করার একটা তাগিদ আছে আওয়ামী লীগের। এ জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারে ব্যাপক জোর দেবে দলটি। প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর আলাদা দল গঠন করে দেওয়া হবে। তারা নির্বাচনী এলাকায় থেকে প্রচার-প্রচারণা তদারক করবে। পাশাপাশি দলের ভেতর কোনো দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধ থাকলে তা মেটানোর চেষ্টা করবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলো বিরোধ মেটাতে না পারলে ঢাকায় ডেকে বোঝানো হবে। মোটকথা, মেয়র পদে দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ হবে। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে আগামী ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ সব নির্বাচনকেই গুরুত্ব দেয়। পাঁচ সিটির ভোটও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য প্রচার-প্রচারণায় কোনো ঘাটতি থাকবে না। আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে ভোটের প্রকৃত আমেজ চলে আসবে। ভোটারও এবার বেশি হবে বলে মনে করেন তিনি।
ভোটারের আগ্রহ বাড়াতে নানা চিন্তা আওয়ামী লীগের
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে না এলেও দু-তিনটি সিটি করপোরেশনে ব্যক্তিগতভাবে বিএনপির কোনো কোনো নেতা বা নেতার সন্তানেরা ভোটে দাঁড়াতে পারেন—এমন তথ্য আছে আওয়ামী লীগের কাছে। বিএনপির কেউ দাঁড়াতে চাইলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাধা না হয়ে বরং উৎসাহ দেওয়া হবে। কারণ, বিএনপির নেতারা দাঁড়ালে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে, যা আওয়ামী লীগেরও লক্ষ্য।
সূত্র আরও জানায়, মেয়র পদে ভোট হবে দলীয় প্রতীকে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন। বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে ধানের শীষ প্রতীক পাবেন না। তখন বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থক ভোট দিতে আসবেন না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সব কর্মী-সমর্থককে কেন্দ্রে আনতে পারলে দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত। এর মাধ্যমে ভোটারের উপস্থিতিও দেখানো যাবে। আবার দলীয় প্রার্থীর জয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাও প্রকাশ পাবে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপনির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সংঘাত হয়নি। এরপরও ভোটারের উপস্থিতি কম থাকার বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। সরকারবিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বলে মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে—আওয়ামী লীগে এমন আলোচনাও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন সম্পর্কে মানুষকে বলার অনেক কিছু আছে। অপপ্রচারের জবাবে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রচার করতে পারলে ভোটারের উপস্থিতি বাড়বে। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেক আগে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন ছিল অনেকটাই ভোটারবিহীন। উপনির্বাচনে ভোটারদের অপেক্ষায় সময় কেটেছে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের। ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গড়ে ভোট পড়েছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচনে এত কম ভোট পড়ার নজির তেমন নেই।
ছয়টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে—মাত্র ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সমর্থন দিয়েছিল। আর সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে—৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।
চলতি বছরের গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর গত বছরের নভেম্বরে ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। যদিও বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে ভোটকে উৎসব হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে নানা অনিয়মের পাশাপাশি বিএনপি ভোট বর্জন করায় ভোটার উপস্থিতি কম হচ্ছে। অবশ্য এ প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের বছর বলে এমনিতেই ভোটারের আগ্রহ একটু বেশি থাকবে। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগও ব্যাপক প্রচার চালাবে। তিনি বলেন, বিএনপি থেকেও অনেকে প্রার্থী হতে পারেন বলে তাঁদের ধারণা। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং ভোটারের উপস্থিতিও বাড়বে।